যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে by হাসান ফেরদৌস

প্যারিসে ও ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নাদিনোতে সন্ত্রাসী হামলা এবং মার্কিন রক্ষণশীল রাজনীতিকদের প্রবল মুসলিমবিরোধী অবস্থানের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম-বিদ্বেষী ঘটনা বেড়ে গেছে। সর্বশেষ ঘটনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভার্জিনিয়ার একটি শহরে সব স্কুল এক দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়।
ওবামা প্রশাসন মুসলিমদের কোনো কোনো ঘটনাকে বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধ বা ‘হেইট ক্রাইম’ হিসেবেই বিবেচনা করছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে গড়ে ১২ দশমিক ৬টি মুসলিমবিরোধী অপরাধ ঘটে থাকে। কিন্তু প্যারিস ও স্যান বার্নাদিনোর ঘটনার পর এই অপরাধের হার তিনগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ঘটনা ঘটেছে ২ ডিসেম্বর স্যান বার্নাদিনোতে দুই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্যক্তির হাতে ১৪ জন নিহত হওয়ার পর। এফবিআইয়ের সূত্র উদ্ধৃত করে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর এমন ব্যাপক মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা দেখা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট ওবামা একাধিকবার নিরপরাধ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ মাসের গোড়ার দিকে ওভাল অফিস থেকে এক ভাষণে তিনি মুসলিমদের আমেরিকার বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যেন ভুলে না যাই যে তারা আমাদের প্রতিবেশী, তাদের অনেকে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে আমাদের দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত।’
নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া ও মুসলিমপ্রধান মিশিগান রাজ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মুসলিমদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মসজিদ ও মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে মুসলিমরাও উদ্বিগ্ন।
ঘটনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন। নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে হিজাব পরিহিত একাধিক মুসলিম নারী বিদ্রূপের সম্মুখীন হয়েছেন। এই শহরের ব্রঙ্কসে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর হিজাব টেনে তাকে ‘আইসিস’ বলে তিরস্কার করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো, আনাহাইম এবং ফ্লোরিডাতেও অনুরূপ ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। পিটসবার্গে একজন মুসলিম ট্যাক্সি ড্রাইভার তারই গাড়ির যাত্রীর গুলিতে সামান্য আহত হয়েছেন। মিশিগানের ডিয়ারবর্নে একজন নারী সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক ও টুইটারে মুসলিমদের আঘাত করার আহ্বান জানালে এফবিআই বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব নেয়। স্যান বার্নাদিনোর ইসলামিক কাউন্সিল জানিয়েছে, সেখানে গাড়ি ধোয়ার দোকানে এক মুসলিম নারীকে চাকু দেখিয়ে ভয় দেখানো হয়। পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ভার্জিনিয়ার আউগুস্তা কাউন্টিতে। সেখানে মাধ্যমিক স্কুলের এক শিক্ষক ছাত্রদের ক্যালিগ্রাফি (হরফ লিখনপদ্ধতি) শিক্ষার ক্লাসে মুসলিমদের কলেমার ক্যালিগ্রাফি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতে প্রথমে ছাত্ররা আপত্তি করে, পরে তাদের অভিভাবকেরা সে প্রতিবাদে যুক্ত হন। অবশেষে প্রবল প্রতিবাদের মুখে ওই জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অন্য আরেক ঘটনায় শিকাগোর হুইটন কলেজের এক শিক্ষক তাঁর ফেসবুক পেজে মুসলিম ও খ্রিষ্টান উভয়ে একই ঈশ্বরের প্রার্থনা করে, এই কথা লেখার অপরাধে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে অপসারিত হয়েছেন। লারসিয়াহকিন্স নামের ওই শিক্ষক মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংহতির অংশ হিসেবে এই মন্তব্য করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
মুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস ব্যাপক জনসংযোগের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে তাঁরা ফ্লোরিডার ট্যাম্পা ও অরলান্ডোর বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের শান্তিপূর্ণ বাণী প্রকাশ করে বিলবোর্ড বসানোর ব্যবস্থা করেছে। আমেরিকার মুসলিমপ্রধান এমন বিভিন্ন শহরে প্রায় ১০০ বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে বলে ইসলামিক কাউন্সিলের পক্ষে একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন।
মুসলিম বিদ্বেষ বাগে আনার জন্য নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও গত সপ্তাহে এই শহরের মুসলিম নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জ্যামাইকায় বাংলাদেশিদের পরিচালিত একটি মসজিদে নামাজের সময় উপস্থিত হয়েছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.