মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন এক শতাব্দী by জেফ্রি ডি শ্যাস

জেফ্রি ডি শ্যাস কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন, স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এবং আর্থ ইনস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সহস্র্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে, The End of Poverty, Common Wealth এবং অতি সাম্প্রতিক The Age of Sustainable Development। জেফ্রি ডি শ্যাস এর ব্যতিক্রমধর্মী এই লেখাটি ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে এ লেখাটি বিশেষভাবে কাজে লাগবে। পশ্চিমা উদারপন্থী ভাবনাও এ লেখায় স্পষ্ট হয়, যদিও পেন্টাগনের কর্তারা এতে কতটা প্রভাবিত হন তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। লেখাটি অনুবাদ করেছেন মাসুমুর রহমান খলিলী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বব্যাংকের মতো পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান বারবারই প্রশ্ন করে- মধ্যপ্রাচ্য কেন নিজেই নিজেকে শাসন করতে পারে না। এই প্রশ্নটি হয়তো তারা সততার সাথে করে থাকে কিন্তু সত্যিকার সচেতনতার সাথে এটি করে বলে মনে হয় না। যে যাই বলুক না কেন, সত্যিকার অর্থে এই অঞ্চলে সুশাসনের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা হলো এখানে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় হস্তক্ষেপের ফলে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
একটি শতকই কিন্তু যথেষ্ট। এই ২০১৬ সালেই টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজস্বতার ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন শতাব্দীর শুরু করা উচিত। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া পক্ষে অটোমান সাম্রাজ্যের অবস্থান নেয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের পরের ১০০ বছরে নিয়তি ঠিক হয়ে যায়। এর ফলে ওসমানীয় সাম্র্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং তুরস্কের বাইরে বাকি অংশ বিজয়ী শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ব্রিটেন ১৮৮২ সাল থেকেই মিসরের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, আর পরে নিয়ন্ত্রণ নেয় আজকের ইরাক, জর্ডান, ইসরাইল-ফিলিস্তিন ও সৌদি আরবের। অন্য দিকে ফ্রান্স উত্তর আফ্রিকার বেশির ভাগ এবং লেবানন ও সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জ্বালানি তেল, বন্দর, নৌ রাস্তা এবং স্থানীয় নেতাদের বৈদেশিক নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের আনুষ্ঠানিক ম্যান্ডেট ও আধিপত্যের অন্যান্য উপকরণ। এটি করতে গিয়ে ইবনে সৌদের হাশেমি হেজাজের আরব জাতীয়তাবাদ থেকে সৌদি আরবকে ওয়াহাবি মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর সমর্থন করে ব্রিটেন।
১৯৪৯ সালে সিরিয়ার সিআইএ মদদপুষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৫৩ সালে ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে সিআইএ’র তৎপরতায় পতন ঘটানোর (দেশের তেল নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমের হাতে রাখতে) মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হস্তক্ষেপের ‘আলোকবর্তিকা’ নিজের হাতে তুলে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সালে লিবিয়ার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে উৎখাত, ২০১৩ সালে মিসরের মোহাম্মদ মুরসির পতন ঘটানো এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একই কাজ বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে আমেরিকা। প্রায় সাত দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের কথামতো না চলার কারণে নিজেরা হস্তক্ষেপ করে (অথবা ভেতর থেকে অভ্যুত্থানে ইন্ধন দিয়ে) অনেক সরকারকে বিদায় করেছে।
এ ছাড়াও পশ্চিমারা শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের পুরো অঞ্চলকে অস্ত্রসজ্জিত করেছে। পুরো অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শত্রুদের হাতে যুদ্ধোপকরণ যাতে না পৌঁছতে পারে তার ব্যবস্থা করতে সিআইএ’র পদক্ষেপ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং এখন পশ্চিমা নেতারা যখন আরব নেতাদের বলছেন তারা কেন নিজেদের শাসন নিজেরা করতে পারেন না তখন তাদের একটি পাল্টা জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই জবাব হলো ‘গোটা এক শতক ধরে তোমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে রেখেছো (আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর এবং অন্যত্র নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে) আর এর প্রভাবে বারবার আঘাত এসেছে স্থিতিশীলতায় এবং এখন যা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নিয়েছে; নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সহিংস জিহাদিদের তোমরা সশস্ত্র করেছ; আর আজ বামাকো থেকে কাবুল পর্যন্ত প্রসারিত এক বধ্যভূমি তোমরা তৈরি করেছ।’
তবে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়তে কী পদক্ষেপ নিতে হবে? আমি এ ব্যাপারে পাঁচটি নীতি গ্রহণের কথা বলব। এর মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটানো বা সরকারকে অস্থির করে তোলার জন্য সিআইএকে তার গোপন অপারেশন বা অভিযানের ইতি ঘটাতে হবে। ১৯৪৭ সালে দু’টি ম্যান্ডেট দিয়ে সিআইএ গঠন করা হয়। এর একটি হলো বৈধ (গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ) আর অন্যটি হলো বিপর্যয়মূলক (মার্কিন স্বার্থের ‘প্রতিকূল’ হিসেবে গণ্য শাসন উৎখাতে গোপন অপারেশন)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পারেন এবং এটি তার করা উচিত যে, সিআইএ’র গোপন অপারেশন বন্ধের জন্য তিনি নির্বাহী আদেশ জারি করবেন। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এখন যে যুদ্ধ ও পাল্টা যুদ্ধ চলছে তার অবসান ঘটবে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হওয়া উচিত তার বৈধ পররাষ্ট্র লক্ষ্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে অর্জনের চেষ্টা করা। আমেরিকার অনুধাবন করা উচিত যে, বর্তমানে তার নেতৃত্বাধীন ‘কোয়ালিশন অব উইলিং’ এ অঞ্চলে শুধু ব্যর্থ হয়নি এমনকি প্রতিপক্ষের ভূ-রেষারেষির কারণে দেশটির আইএসের গতি রোধ করার মতো বৈধ পদক্ষেপও বাধার মুখে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেটাকে নিরাপত্তা পরিষদের ভোটের জন্য দিলে বেশি লাভবান হতে পারত। ২০০৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদে ইরাক যুদ্ধ প্রস্তাব যখন প্রত্যাখ্যাত হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উচিত ছিল এই অভিযান থেকে বিরত হওয়া। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন স্থায়ী সদস্য রাশিয়া যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের মার্কিন সমর্থিত উৎখাত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে তখন তাকে বিদায় করতে গোপন অভিযান থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। আর এখন, সমগ্র নিরাপত্তা পরিষদ ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ এর বিরুদ্ধে লড়তে বৈশ্বিক পরিকল্পনা তৈরি করেছে (কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্যোক্তা নয়)।
তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের এই বাস্তবতা গ্রহণ করে নেয়া উচিত যে, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের চর্চার ক্ষেত্রে ভোটে অনেক ইসলামি দল জয়ী হতে পারে। অনেক দুর্বল সরকার যেভাবে ব্যর্থ হয় সেভাবে নির্বাচিত ইসলামি দলের সরকারও ব্যর্থ হতে পারে। তারা পরবর্তী নির্বাচনে অথবা রজপথে আন্দোলনে এমনকি স্থানীয় জেনারেলদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণকে বিবেচনায় না এনে সব ইসলামি সরকারকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে তা এই অঞ্চলের দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
চতুর্থত, উত্তর আফ্রিকা থেকে সাহেল অঞ্চল পর্যন্ত এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত স্থানীয় নেতৃত্বের এই স্বীকৃতি দেয়া উচিত যে, আজ ইসলামি বিশ্বের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষার মান। বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, শিল্পোদ্যোগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায় উন্নয়ন এবং (এর মাধ্যমে) কাজ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই অঞ্চল অনেক পিছিয়ে আছে। উচ্চমানের শিক্ষা ছাড়া কোনো স্থানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সামান্য সম্ভাবনাও থাকে না।
অবশেষে, পরিবেশের অবক্ষয়ে এই অঞ্চলের ভঙ্গুরতা এবং বিশেষভাবে জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন পর্বে বৈশ্বিক স্থানান্তরের ফলে তেলের ওপর অতি নির্ভরতা যে বিপদ ডেকে আনতে পারে তা কাটানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল বিশ্বের বৃহত্তম জনবহুল শুষ্ক অঞ্চল (৫,০০০ মাইল বা ৮,০০০ কিলোমিটার)। এই এলাকায় ব্যাপক পানির ঘাটতি, মরুকরণ প্রবণতা, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। যেগুলো হলো মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব চ্যালেঞ্জ। সুন্নি-শিয়া বিভাজন, আসাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং মতবাদজনিত বিরোধ এ অঞ্চলের জন্য মানোত্তীর্ণ শিক্ষা, কর্মদক্ষতা, উন্নত প্রযুক্তি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় সন্দেহাতীতভাবে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ইসলামি বিশ্বে অনেক সাহসী এবং প্রগতিশীল চিন্তাবিদ রয়েছেন যাদের এই বাস্তবতার ব্যাপারে তাদের সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর সারা বিশ্বের সুবিবেচনাপ্রসূত সব মানুষের উচিত হবে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং সাম্রাজ্য বিস্তার ধরনের যুদ্ধ ও কারসাজির অবসান ঘটানো।

No comments

Powered by Blogger.