অবহেলিত শিশুদের পাশে সোনালি স্বপ্ন by এম মাঈন উদ্দিন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে শাহেরখালী ইউনিয়নের শেষ প্রান্ত গজারিয়া বেড়িবাঁধের বঙ্গোপসাগরের মোহনা। এই বেড়িবাঁধে বসবাস অসহায় দরিদ্র মানুষদের। যারা নিজের বসতভিটা না থাকায় এখানে এসে বসত করছেন। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা এ পরিবারগুলো জেলে পরিচয়ে বেড়ে ওঠে। সাগরে মাছ ধরাই তাদের পেশা বলে মানুষের মাঝে ওরা অবহেলিত। তাদের সন্তানেরা চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশু। ভাঙা কুটিরে বসবাস তাদের। গায়ের জামাও মলিন। চেহারায় অযতœ অবহেলার চাপ। গাঁয়ের কাদামাটি মেখে ওদের বড় হওয়া, নদীতে মাছ ধরে, বনে কাঠ কেটে ওরা ছোট্ট বয়সেই সাংসারিক দায়িত্বের ভার নেয়, ওদের কারো বাবা নেই, কেউ এতিম আবার কেউ বা প্রতিবন্ধী।
মেয়েরা অল্প বয়সে হয়ে যায় সংসারিনী। ছেলেরা ধরে সংসারের হাল। ওদের জীবন বদলাতে এগিয়ে আসে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের কিছু শিক্ষিত তরুণ। তারা প্রথমে গড়ে তোলে একটি সংগঠন ‘সোনালি স্বপ্ন পাঠশালা’।
সাগরপাড়ে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় ছোট্ট একটি টিনের ঘরে। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আসে পাঠশালায়। যে গ্রামে আগে কেউ আগে পড়েনি, তাদের কাছে কষ্ট হলেও আনন্দের। মা-বাবাও খুশি, সন্তানেরা অক্ষরজ্ঞান লাভ করে শিক্ষিত হচ্ছে দেখে। খেলাচ্ছলে জীবন গঠনের শিক্ষা নেয় পরম মমতায়। গ্রামে স্কুল না থাকায় ওরা আগে স্কুলে যেত না। প্রাথমিক শিক্ষাও ওদের কপালে জুটত না। পেত না কারো সহানুভূতি। সোনালি স্বপ্ন দুই বছর ধরে তাদের পাশে আছে, ওদের শিক্ষিত করার ভার নিয়েছে, শিশুদের আলোর পথে আনার জন্য ‘সোনালি স্বপ্ন পাঠশালা’ কাজ করে যাচ্ছে অবিরাম। একজন-দু’জন করে এখন প্রায় ৫০ জন শিশু পাঠশালায় পড়তে যায়।
শিশুদের অনেক দিনের চাওয়া ছিল সবাই মিলে একদিন পিকনিক করার। সবাই একসাথে মজা করবে, আনন্দ করবে, খাবার খাবে, গান গাইবে। ওই ইচ্ছাও পূর্ণ হলো গত শনিবার (১২ ডিসেম্বর)। শিশুদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে ওঠে জনপদ। ওদের সাথে আমিও একটা দিন কাটালাম, মজা করলাম, দুপুরে একসাথে খেলাম, বনের পাশেই হলো বনভোজন।
শীত হারবে মানবতার কাছেÑ এই স্লোগানে সোনালি স্বপ্ন পাঠশালার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আনন্দটা দ্বিগুণ হলো চট্টগ্রাম শহরের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের সংগঠন ‘রংধনু ফাউন্ডেশন’-এর কল্যাণে। গ্রামকে অন্তরে ধারণ করে, শহর থেকে এসে পাঠশালার শিশুদের প্রতিটি পরিবারের মাঝে তারা তুলে দিলেন শীতবস্ত্র (কম্বল)। পিকনিকের আয়োজন, সাথে নতুন কম্বল আর অতিথিদের আদরযত্নে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের চোখেমুখে খুশির অন্ত ছিল না, তৃপ্তির হাসি ছিল সবার মুখে।
সোনালি স্বপ্নের অন্যতম কর্ণধার মমিনুল হোসাইন টিপু জানান, এখন থেকে প্রায় দুই বছর আগে আমরা কয়েকজন বেড়িবাঁধে ঘুরতে আসি। এখানে এসে দেখি, অনেক শিশু রয়েছে তারা কেউ পড়াশোনা করে না। একটু বড় হলেই তারা মাছ ধরা, কাঠ কাটাসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে। কারণ, তাদের পাশে কোনো স্কুল নেই। বছরের পর বছর শিক্ষার আলো বঞ্চিত হচ্ছে। প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। যে স্কুলে যাওয়া এই ক্ষুদে শিশুদের জন্য কষ্টসাধ্য। সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহ ছিল না অভিভাবকদের। সেই সময় আমরা মনস্থির করলাম, এই অবহেলিত শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে।
তাই আমরা ওই এলাকার সব পরিবার থেকে শিশুদের খুঁজে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে পাঠদান শুরু করলাম। প্রথমে অল্প সংখ্যক শিশু থাকলেও পরে ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী রয়েছে। এরপর আমরা ওই এলাকায় বসবাসরত সব পরিবারের লোকজনের সাথে আলোচনা করি। শিক্ষার ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করি। এভাবে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের স্বপ্ন অনেক দূরে। আমরা অবহেলিত শিশুদের অনেক দূরে পৌঁছে দিতে চাই, যেখানে তারা একদিন সমাজের নেতৃত্বে দেবে।
সোনালি স্বপ্ন সংগঠনের উদ্যোক্তা মমিনুল হোসাইন টিপু, সব সদস্যসহ এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক স্বাগতম বড়ুয়া, আবু মোহাম্মদ কায়সার, নাজনিন কামাল, সাংবাদিক নুরুল আলম, লেখক ও সমাজকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান লিটন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায়ী এবং সমাজকর্মী কাজী সেলিম, সংগঠক আবু তাহের শিবলু, রংধনু ফাউন্ডেশনের ৩০ জন সদস্যহ আরো অনেকে। সমাজসেবক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শাহীদুল ইসলাম চৌধুরীর আগমন অনুষ্ঠানকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। এভাবেই একদিন বদলে যাবে দেশ, শিক্ষার আলো সবার ঘর আলোকিত করবে।

No comments

Powered by Blogger.