গণতন্ত্রে এখন ভাটার টান by এ কে এম জাকারিয়া

গণতন্ত্রের জোয়ার-ভাটা বলে একটি বিষয় রয়েছে। কখনো দুনিয়াজুড়ে এর ঢেউ আছড়ে পড়ে, আর সেই পর্ব শেষ হলে গণতন্ত্রে আসে ভাটার টান। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি বইয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের তিনটি জোয়ারের সময়ের কথা বলেছেন। এই জোয়ারগুলোর মাঝে ভাটার পর্ব গেছে। বাংলাদেশও গণতন্ত্রের এসব জোয়ার-ভাটার বাইরে নয়।
আমাদের দেশে এরশাদ বা স্বৈরাচার পতনের ২৫ বছর পূর্তির সময় ‘গণতন্ত্র’ বিষয়টি আবার আলাপ-আলোচনায় এল। স্বৈরাচার পতনের সঙ্গে যে গণতন্ত্রের একটি সম্পর্ক ছিল (গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, গণতন্ত্র ফিরে পাওয়া বা গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করা), সেটা প্রায় ভুলতে বসার দশা হয়েছিল। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে শুধু নয় বছর সময়ই লাগেনি, দিতে হয়েছে অসংখ্য জীবন। এর পরের ২৫ বছরে আমরা কী পেলাম—এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যে গণতন্ত্রের বর্তমান দশা নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও কিছু হায়-আফসোস এবার আমরা শুনতে পেলাম।
হান্টিংটনের বইয়ে ফিরে আসি। তিনি তাঁর বইটিতে লিখেছেন, আধুনিক গণতন্ত্রের যে যাত্রা, তা তিনটি পর্ব বা ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। গণতন্ত্রের প্রথম ঢেউটি ছিল ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত। প্রায় ১০০ বছরের দীর্ঘ এই জোয়ারের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ভাটার সময় গেছে গণতন্ত্রে। তখন কোথাও ফ্যাসিজমের বিকাশ হয়েছে, কোথাও কোথাও কমিউনিজম। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর বিজয়ের পর। বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব গণতন্ত্রে আবার চলে ভাটার টান। সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জোরদার হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী শাসন। গণতন্ত্রের শেষ জোয়ারটি বয়ে গেছে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, এ সময়ে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ১৯৯৪ সাল নাগাদ বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২।
হান্টিংটনের এই গণতন্ত্রের জোয়ার-ভাটার হিসাব অনুযায়ী, এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন গণতন্ত্রের জোয়ারের পর্ব চলছিল। সম্ভবত সে কারণেই এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রায় শুরু থেকেই এর বিরোধিতা শুরু হয়। বড় ভুল সময়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি! কিন্তু এরপরও নয় বছর ক্ষমতা দখল করে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। তবে গণতন্ত্রের জোয়ার থাকতে থাকতেই তাঁকে হটানো গেছে। আরও বছর দু-এক টিকে গেলে হয়তো তাঁকে সরানো কঠিন হতো। কারণ, হান্টিংটনের মত মেনে নিলে গণতন্ত্রের তৃতীয় ও শেষ জোয়ারটি ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ভাটার শুরুটা তবে হয়েছে এরপর থেকেই। এ ধরনের সময়ে স্বৈরশাসকদের সরানো কঠিন হওয়ারই কথা।
গণতন্ত্রের বর্তমান ভাটার সময়টি আগেরগুলোর চেয়ে ভিন্ন। এই যে প্রায় ২৪ বছর ধরে বিশ্ব গণতন্ত্রে ভাটার পর্ব চলছে, এতে কিন্তু আগের মতো গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমেনি। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশও কিন্তু তার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচিতি হারায়নি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫ সালের পর বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমেনি। ২০১৪ সালে বিশ্বে নির্বাচিত গণতন্ত্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ১২৫-এ। প্রশ্নটি এখন সংখ্যার নয়, মানের। এই সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সরকারব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের বদলে ভিন্ন কিছু বেছে নেয়নি। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে। সমাজের সবকিছুর ওপর সরকারগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ কঠোর থেকে কঠোর করতে যাচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে (জানুয়ারি মাসে) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের মান পড়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে তারা এ তথ্য দিয়েছে। ফ্রিডম হাউসের হিসাব অনুযায়ী গণতন্ত্রে এই বাজে দশা চলছে সেই ২০০৫ সাল থেকে। আর ২০১৪ সাল ছিল বিশেষ করে সবচেয়ে খারাপ বছর। বিশ্বের ৬১টি দেশে সে বছর গণতন্ত্রের মান পড়েছে। উন্নত হয়েছে মাত্র ৩৩টি দেশে। গত নয় বছরের মধ্যে এই পরিস্থিতি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ।
দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি কেন খারাপের দিকে যাচ্ছে? এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন মার্কিন থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের রবার্ট কেগান। ব্রুকিংস জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ‘ইজ ডেমোক্রেসি ইন ডিক্লাইন’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপারে একসময় পশ্চিমারা যে সমর্থন দিয়ে গেছে এবং এর পক্ষে যে জোরালো ভূমিকা (আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো তা পশ্চিমের নাক গলানো ও মোড়লিপনা) পালন করেছে, সেই অবস্থান থেকে তারা সরে এসেছে। তাঁর মত হচ্ছে, সে জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা জোরদার হয়েছে। তিনি লিখেছেন, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এখন তাদের পুরোনো চর্চা বন্ধ করেছে অথবা নিজেদের সমস্যা সামাল দিতে ব্যস্ত রয়েছে। চীন ও রশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর প্রভাব ও ভূমিকার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের দেশগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে যেমন প্রভাবিত করছে, তেমনি আঞ্চলিকভাবেও প্রভাব সৃষ্টি করছে, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
তবে এই যে কর্তৃত্ববাদী শাসন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জেঁকে বসছে, এর নেতারা কিন্তু আগের স্বৈরশাসকদের মতো নন। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক উইলিয়াম ডবসন তাঁর দ্য ডিক্টেটরস লার্নিং দ্য কার্ভ (২০১২) বইয়ে বলেছেন, বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা অতীতের স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে শিখেছেন। আগের স্বৈরশাসকদের জন্য কাজটি খুব সহজ ছিল। তখন কোনো ফেসবুক, ইউটিউব বা টুইটার ছিল না। তিনি লিখেছেন, আজকের দুনিয়ায় একজন স্বৈরশাসক তাঁর কোনো অপকর্ম গোপন রাখার আশা করতে পারেন না। ‘এমনকি আপনি যদি হিমালয় পর্বতের কোনো গিরিপথেও সহিংস অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন, তারপরও জানবেন যে এটা কোনো না কোনো আইফোনে ধরা পড়বে এবং সারা দুনিয়ায় তা প্রচারিত হবে।’ বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা নির্মমতার দিক থেকে পিছিয়ে না থাকলেও তাঁরা অনেক পরিবর্তনকেই গ্রহণ করেছেন। আগের স্বৈরশাসকদের তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি ‘পরিশীলিত, বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ও চটপটে’। ২০ বছর আগের স্বৈরশাসকেরা জানতেন না এনজিও ব্যাপারটি কী। আজ এনজিওগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা পুরোনো স্বৈরশাসকদের চেয়ে অনেক বেশি পটু হয়ে উঠছেন। তাঁদের এই দক্ষতা বৃদ্ধি গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে।
তবে কর্তৃত্ববাদী শাসন বিস্তারের পেছনে আরও অনেক কিছুই রয়েছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও ভেডোমস্তি পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক মারিয়া স্নেগোভায়া মস্কো টাইমস পত্রিকায় এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন, গণতন্ত্রের বর্তমান কর্তৃত্ববাদী মডেল জনগণের একটি অংশের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘দ্য পিপল হ্যাভ স্পোকেন: নো মোর ডেমোক্রেসি’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টিয়ান ক্যারলকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, অধিকাংশ জনগণের কাছে গণতন্ত্রই শেষ কথা নয়। অনেকেই গণতন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার উৎস হিসেবে। মারিয়া লিখেছেন, গণতন্ত্র এসব নিশ্চিত করতে না পারলে কী হতে পারে, তার একটি উদাহরণ হচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে থাই জনগণের রাস্তায় নেমে আসা।
মিসরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেখানে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানে এবং সেখানকার জনগণের একটি বড় অংশ তাকে সমর্থন জানিয়েছে। স্যামুয়েল হান্টিংটন এ ধরনের প্রবণতা সম্পর্কে বলেছেন, নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কখনো ‘ওপর’ থেকে চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং অভিজাতদের চাপেই এমনটা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক দেশই এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধারণ করতে প্রস্তুত নয়।
হান্টিংটন গণতন্ত্রের যে তিনটি জোয়ার পর্বের কথা বলেছেন, তার প্রথমটি প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। আর পরের দুটির মেয়াদ ছিল প্রায় এক যুগ ও দেড় যুগ। মাঝের দুটি ভাটার সময় গেছে প্রায় ২০ বছর ও ১২ বছর। ’৯১-এর পর যে তৃতীয় ভাটা শুরু হয়েছে, তা কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় ২৪ বছর সময় পার করেছে। বলা যায়, গণতন্ত্রে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভাটা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাটা কাটবে কবে? বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে খুব আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জোয়ারগুলোর পেছনে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তির অবস্থান ও নজরদারির যে ভূমিকার (অথবা নাক গলানো) কথা বলা হয়, সে ধরনের কিছু নতুন করে জোরদার হবে, এমন কোনো লক্ষণ আমাদের সামনে পরিষ্কার নয়।
আইএস বা নানা ধরনের সন্ত্রাসী হামলা থেকে নিজের দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে ব্যস্ত পশ্চিমাদের বিশ্ব গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার সময় এখন আদৌ আছে কি? সেখানকার গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যেই বরং কর্তৃত্ববাদ জোরালো হয়ে ওঠার লক্ষণ ফুটে উঠছে। তা না হলে রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষস্থানীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করে দাবি করতে পারেন যে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে সাময়িকভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে! প্যারিসে হামলার পর ফ্রান্সের স্থানীয় নির্বাচনে ডানপন্থীদের বিজয়ও একই ইঙ্গিত দেয়।
গণতন্ত্রের এই দীর্ঘতম ভাটা বিশ্বকে সম্ভবত এক নতুন ইতিহাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.