অগ্নিপরীক্ষায় মোদির পরাজয় by ইফতেখার হোসেন

১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই বিহারের পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব দুর্নীতির দায়ে কারাগারের ফটকে পা রাখতেই তাঁর স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মোবাইল ফোনে একটা কল দিলেন। রাজনীতিতে রাবড়ি দেবীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নয় সন্তানের ধকল-ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই তাঁর জীবনটা কেটে গেছে। তবু লালুর ইচ্ছার ব্যত্যয় ঘটানোর মতো স্পর্ধা তাঁর নেই। তাঁর অনুরোধেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত হন রাবড়ি। এরই জের ধরে ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় এক যুগ তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
নিতীশ কুমারের আনুগত্য-ভাগ্য ছিল কিছুটা দুর্বল। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিহারে তাঁর দলের হলো ভরাডুবি; নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যেখানে পেল ৩১টি আসন, মুখ্যমন্ত্রী নিতীশের দল পেল সর্বসাকল্যে দুটি। অভিমানে নিতীশ পদত্যাগ করলেন। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন তাঁরই আস্থাভাজন জিতন রাম মাঝির হাতে। অভিমান অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হলো না। নিতীশ চাইলেন পুরোনো পদ ফিরে পেতে। মাঝি তখন বেঁকে বসলেন; দেনদরবার করতে ছুটলেন দিল্লিতে। নিতীশ সভা ডেকে মাঝিকে দল থেকে বহিষ্কার করলেন। আস্থা ভোটে নিতীশ আবার ফিরে পেলেন তাঁর হারানো কুরসি।
১৯৯০ সালে লালুপ্রসাদ জনতা দলের পক্ষে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। সমাজ ও রাজনীতিতে হিন্দু উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র আধিপত্য লালু ভেঙে দিলেন। একে একে অংশীদারত্ব ও জনকল্যাণমূলক নীতিও গ্রহণ করলেন তিনি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দিলেন। লালু হয়ে উঠলেন জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল লালুর দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা। যাদবের বাইরের হিন্দু নিম্নবর্ণের অন্য জাতপাতরা বঞ্চিত হতে লাগল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে এল।
সমাজবাদী নিতীশ কুমার এককালে ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণের ভাবশিষ্য। নিতীশ লালু যাদবের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন ১৯৯৫ সালেই, জড়িয়ে পড়েন দিল্লির রাজনীতিতে, মন্ত্রী হন। ২০০৫ সালে রাষ্ট্রীয় জনতা দল—ইউনাইটেড (আরজেডিইউ) গঠন করেন এবং বিজেপির সমর্থনে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এই পদ ধরে রাখেন। নিতীশের আমলে বিহারে আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে, দুর্নীতি কমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিহারের বিধানসভার নির্বাচনকে নিয়েছেন অপরিসীম গুরুত্বসহকারে। গত ১৮ মাসের ক্ষমতায় মোদি-হাওয়া অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে, প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বটে, তবে সেটা বিগত ধারার সঙ্গে সংগতি রেখেই। বিদেশে পাচারকৃত ভারতীয় অর্থের ভগ্নাংশও দেশে ফেরেনি। ভূমি অধিগ্রহণ, কর পুনর্গঠন নীতিমালার মতো বড় বড় সংস্কার পরিকল্পনা লোকসভায় থমকে গেছে। পুঁজিবাজার ও মুদ্রা-মূল্যমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মোদি ধাক্কা খেয়েছেন দিল্লিতে, কেজরিওয়ালের কাছে। বিহারের নির্বাচন বিজেপির জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অগ্নিপরীক্ষা। এখানে জিতে আসতে পারলে আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা ও ২০১৭-এর উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি আস্থার অবস্থানে চলে আসতে পারবে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি অবশ্য মোদির জন্য পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। দাদরিতে গো-হত্যার মিথ্যা অভিযোগে নিরপরাধ মুসিলম হত্যা, হরিয়ানায় দুই ঘুমন্ত শিশুকে পুড়িয়ে মারা; সামগ্রিকভাবে সমাজে ধর্মীয় বিভাজন ও সহিংসতা বৃদ্ধি—এ সবই অনেকের কাছে ভারতের গতানুগতিক সহনশীলতার ঐতিহ্যের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হতে শুরু করে। এসবের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে শুধু যে অপারগই হচ্ছেন তা-ই নয়, কারও কারও বক্তব্য পরিস্থিতিকে অধিকতর ঘোলাটে করে তুলছে। বিহারের রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতপাত—এ দুটিই সংবেদনশীল।
বিহারের নির্বাচনী ফলাফলে ধর্ম ও জাতপাত মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, সন্দেহ নেই। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে নিতীশের জেডিইউ পেয়েছিল ১৬ শতাংশ ভোট, এবারে ভোটের পরিমাণ এর চেয়ে কম হওয়ার কারণ নেই। মুসলিম, যাদব আর কুরমিদের ভোট যথাক্রমে ১৮, ১৩ ও ৪ শতাংশ; সব মিলিয়ে ৩৫ শতাংশ। নিতীশ-লালুর মহাজোটে সোনিয়া-রাহুলের কংগ্রেসও অংশীদার।
লালু যাদব আর নিতীশ কুমারের মধ্যে সম্পর্ক একসময় ছিল শীতল। ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের দুই দল পৃথকভাবে নির্বাচন করেছে। ভরাডুবি ঘটেছিল উভয় দলেরই। এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে এবার তাঁরা জোট গড়েছেন। প্রতিপক্ষের শত উসকানিতেও চিড় ধরছে না এই জোটে। নিতীশ নেমেছেন ‘অতিভদ্রের’ ভূমিকায়। তাঁর এক সভায় এক সাংবাদিক কিছু একটা প্রশ্ন করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সম্পর্কে। নিতীশ পরপর দুবার তাঁকে তিরস্কার করলেন নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দটি ব্যবহার না করার অপরাধে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু হেদায়েতও করে দিলেন শিষ্টাচার বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর। মোদি নিতীশকে অহংকারী ও লালুকে শয়তান বলেছিলেন। নিতীশ এরও সমালোচনা করে বলেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথাবার্তা শোভা পায় না। লালু যাদব অবশ্য নিতীশের উপদেশের খুব একটা তোয়াক্কা করছেন না। লালু মোদিকে রাবণ, পিশাচ আখ্যায়িত করে হুংকার দিয়েছেন। বলেছেন, রাবণের রাজনীতির অবসান তিনি বিহারেই ঘটাবেন। মোদিও সুযোগমতো এর পাল্টা জবাব দিয়েছেন। নিতীশ বুঝেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহারাদের সমর্থন আশা করাটা বৃথা। লালু বুঝেছেন ‘জঙ্গল-রাজের’ স্মৃতি এখনো জনগণের চেতনায় তাজা। নিপুণ যুগলবন্দীর বাঁশি বাজাচ্ছেন বিপরীত আদর্শ ও চরিত্রের এ দুই নেতা। মোদি বড় বড় সমাবেশ করেছেন, প্রবৃদ্ধির কথা বলেছেন, অর্থবিত্তের কথা ছড়িয়েছেন, বিহারকে উন্নতির মোড়কে মুড়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আর তারই ছায়ায় ছায়ায় লালু-নিতীশ জনসংযোগ করেছেন; একজন বলেছেন সুশাসনের কথা, অন্যজন অন্তর্ভুক্তির বাত বাতলেছেন। ‘গাঁটছড়া জোটের’ এ যেন চাণক্যের চমক রাজনীতি!
১৪ দিন চলে গেছে, মগধার রাজা জরাসন্ধ ও পাণ্ডব রাজপুত্র ভীমের মল্লযুদ্ধে কেউ কাউকে কাবু করতে পারছে না। অগত্যা ভীম রণেভঙ্গ দিয়ে বুদ্ধি আঁটতে ছুটে গেল কৃষ্ণের দরবারে। কৃষ্ণ বাতলে দিল সহজ পথ। জরাসন্ধকে গাছের কচি ডালের মতো ভেঙে ফেলতে পারলেই কাজ সারা। কালক্ষেপণ না করে ভীম মট করে জরাসন্ধকে দুই টুকরা করে ফেলল। বধ্ হলো জরাসন্ধ। মগধার রাজধানী ছিল বিহারের রাজধানী পাটনার অদূরের রাজগিরেতে।
নির্বাচনী প্রচারণার মাঝামাঝি, দুই দফা ভোট পর্বের পর, বিজয়া দশমী উপলক্ষে মোদি ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। মন্দ লোকে বলাবলি করেছে, ভোটের ফলাফল আঁচ করতে পেরেই মোদির এই সাময়িক প্রস্থান। দুই সপ্তাহ পর ফিরে এসে বিহারে তিনি পুনরায় পুরোদস্তুর প্রচারকাজে নেমেছিলেন।
বোফর্স অস্ত্র চুক্তি কেলেঙ্কারির গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজীব গান্ধী তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে ভিপি সিংকে বরখাস্ত করলেন। ভিপি সিং ছিলেন নীতিবান সমাজতন্ত্রীমনা রাজনীতিক। পরের বছর ১৯৮৮ সালের ১১ অক্টোবর জেপির জন্মদিনে কয়েকটি ছোট দলের সমন্বয়ে ভিপি সিং গঠন করলেন জনতা দল। এর ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হলো জাতীয় ফ্রন্ট। এর পরবর্তী ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনবদ্য। ভিপি সিং নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে ঐক্য গড়ে তুললেন ডানপন্থী বিজেপি ও বামপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে। ১৯৮৯-এর নির্বাচনে জাতীয় ফ্রন্টের নির্বাচনী ঐক্য কংগ্রেসকে পরাস্ত করে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল। ডিসেম্বরে ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করলেন। ভিপি সিংকে বলা হয় মোর্চা গঠনের দক্ষ কারিগর।
নিতীশ কুমারের বর্তমান অবস্থান অনেকাংশেই ভিপি সিংয়ের তৎকালীন অবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। মোর্চা গঠনের দক্ষতায়ও ভিপি সিংয়ের সঙ্গে তাঁর মিল রয়েছে। নিতীশ জোট করেছেন ভিন্ন মেজাজের আরজেডি আর কংগ্রেসের সঙ্গে। মহাগাঁটবন্ধন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মোদির বিজেপিকে হারিয়ে দিয়েছে। জোট করে ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী থাকতে পেরেছিলেন এক বছরেরও কম সময়। বিজেপি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। রাজীব গান্ধীর সমর্থন পেয়ে ভিপি সিংয়ের দলের নেতা চন্দ্র শেখর সুযোগ বুঝে পৃথক দল গঠন করে জোট ছেড়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে লালু যাদবের আরজেডি নিতীশের জেডিইউর চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। নিতীশের সরকারে লালুর প্রভাব থাকবে দৃশ্যমান। কংগ্রেসও সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। এই জায়গাটিতেই নিতীশের বিপদের আশঙ্কা।
অপর পক্ষে এই বিজয় নিতীশের সামনে সর্বভারতীয় রাজনীতির নতুন দুয়ার উন্মোচিত করল। বিজেপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক অর্থে বিহারের নির্বাচনী ফলাফল ভারতের বর্তমান রাজনীতিতে এক বড় ধরনের ‘গেম চেঞ্জার’। বিজেপিকে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে, ‘উন্নয়নের’ স্লোগান দিয়ে লোক ভোলানোর সহজ পন্থা আর কাজে খাটবে না। নিতীশকে কেন্দ্র করে ভারতে বিজেপিবিরোধী রাজনীতি চাঙা হয়ে উঠবে। এই লক্ষ্যে রাহুল গান্ধী ইতিমধ্যে পরোক্ষভাবে নিতীশের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিতীশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও মোর্চা গঠনের নিপুণতা তাঁকে সামনে এগিয়ে নেবে। এই মুহূর্ত থেকেই ভারতের আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে নীতিশের শ্যেনদৃষ্টি থাকবে, তাতে আর সন্দেহ কোথায়! ২০১৪ সালে এনডিএর পক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হওয়াতেই নিতীশ লোকসভা নির্বাচনে বিহারে পৃথকভাবে প্রার্থী দিয়েছিলেন, বিজেপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নয়।
তবে শেষের পরও শেষ কথা থেকে যায়। বিহারের বিধানসভার বৃহত্তম দল হিসেবে ফিরে আসা লালুজিরও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আগ্রহ আছে প্রচুর, এর আভাসও তিনি দিয়ে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে নিতীশজিকে এখানেও বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
ইফতেখার হোসেন: জাতিসংঘের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।

No comments

Powered by Blogger.