বাড়ই পাড়ায় আতঙ্ক by মহিউদ্দিন অদুল ও হাফিজ উদ্দিন

আশুলিয়ায় নন্দন পার্কের সামনে রয়েছে আরও একখণ্ড নৈসর্গিক নান্দনিকতা। মহাসড়কের পাশঘেঁষা শালবনের শ্যামল ছায়ায় নিভৃত শান্ত পল্লী। বাড়ই পাড়া একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। পুলিশের ওপর একটি অতর্কিত দুর্ধর্ষ হামলার ঘটনা পালটে দিয়েছে এ এলাকার স্বাভাবিক জনজীবন। পুলিশি অভিযানে নিরীহ এলাকাবাসী আটক হওয়ার পর আতঙ্ক ও অবিশ্বাস কেড়ে নিয়েছে শান্তি আর স্বস্তি। বন্ধ হয়ে গেছে বহু পরিবারের জীবিকা। ঘটনার নয় দিন পরও বিরাজ করছে ভুতুড়ে নিস্তদ্ধতা। ফিরে আসেনি স্বাভাবিক কোলাহল। চিরচেনা কর্মব্যস্ততা। পুরো এলাকার অনিন্দ্য নৈসর্গিক নান্দনিকতা আজ বড়ই বিমর্ষ।
সাভারের আশুলিয়ার নন্দন পার্কের সামনের এলাকা পরিদর্শনে গেলে ভয়ে এড়িয়ে চলছিলেন স্থানীয়রা। লুকিয়ে পড়েছিলেন বেশ কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ বাক্য ব্যয় করে তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে হয়। দেলোয়ারা বেগম নামে এক মহিলা বলেন, ‘সত্য বলতে কী? এখন নতুন কাউকে দেখলেই ভয় হয়। কখন আবার জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ধরে নিয়ে যায়। স্যার, আপনাদের দেখেই ভয়ে আমাদের পেট কামড়িয়ে উঠছিল।’
গত ৪ঠা নভেম্বর সকালে সশস্ত্র পাঁচ পুলিশ সদস্যের ওপর ফিল্মি স্টাইলে আতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের কোপে নিহত হন শিল্প পুলিশে কর্মরত কনস্টেবল মুকুল হোসেন। গুরুতর আহত হন অপর কনস্টেবল নূরে আলম ছিদ্দিক। সুস্থ হয়ে ওঠায় গত মঙ্গলবার সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। হামলার আকস্মিকতায় প্রতিরোধ গড়তে না পারায় সঙ্গে থাকা অপর তিন কনস্টেবল পিনারুজ্জামান, আপেল মাহমুদ ও ইমরান আজিজকে পরে বহিষ্কার করা হয়।
ওই দিন হামলার সময় ঘটনাস্থলের পাশে মায়ের দোয়া হোটেলে কর্মরত প্রত্যক্ষদর্শী বকুল মোল্লা বলেন, ঘটনার চিৎকার-চেঁচামেচি এবং হুড়োহুড়িতে আমিও দৌড়ে সরে পড়ি। পরে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে পাই। এরপর পুলিশ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। যারা অন্যায় করেছে তারা পালিয়ে গেছে। কিন্তু এখন হয়রানির শিকার হচ্ছি আমরা নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। এদিকে দোকান খোলতে পারছি না। আবার এক সপ্তাহ ধরে আমি খুবই অসুস্থ। তার পরও পুলিশের সন্দেহে পড়ার ভয়ে এলাকা ছাড়তে পারছি না।
সরজমিন দেখা যায়, ঘটনাস্থলটি ঢাকা ও গাজীপুর জেলার সীমানায়। গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার ‘স্বাগতম’ লেখা সাইনবোর্ডটি তা জানান দিচ্ছে। আশুলিয়ার নন্দন পার্কের বিপরীতে ঝুপড়ি দোকানগুলোর সামনেই এ হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল দেখা যায়, ছয়টি দোকানই অবহেলিত ও খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সাইনবোর্ডের পাশের দোকানটির প্রবেশপথে ও কিছুটা মাঝখানে মুকুলের রক্তের দাগ এখনও রয়েছে। চৈত্রের খরতাপে বিলঝিল শুকিয়ে ফেটে যেমন চৌচির হয়ে যায়, তেমনই মানচিত্রের রূপ পেয়েছে তার শুকানো রক্তের ধারা। ছয় দোকানের এলোমেলো বেঞ্চগুলোতে ধোয়া-মোছা নেই। ধুলোবালির পুরো স্তরে স্বাভাবিক বর্ণ হারিয়ে ধূসর হয়ে গেছে সেগুলো। দোকানগুলোর পেছনে শালবন পেরিয়ে অর্ধশতাধিক পরিবারের বাস। মানচিত্রের মতো এঁকেবেঁকে চলা ওই বনের পাশ ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বসতিগুলো। ঝুপড়ি দোকানগুলোর পাশ ও জঙ্গলের ভেতর দিয়েই ছিল তাদের চলাচলের মেঠোপথ। এখন সেই সংক্ষিপ্ত সহজ পথও কেউ ব্যবহার করছে না। দূরের পথ দিয়ে ঘুরে যাওয়া-আসা করছেন স্থানীয়রা। ওই স্থান থেকে ঢাকাগামী বাসগুলোর স্টপেজও কয়েক শ গজ দক্ষিণে বাড়ই পাড়া বাজারের কাছে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে আগে একটি দোকান বন্ধ থাকলেও এ ঘটনার পর থেকে বাকি পাঁচটিও খোলেননি ব্যবসায়ীরা। নন্দন পার্কের সামনের ওই এলাকায় ১০০ থেকে ২০০ মানুষের নিত্য আনাগোনা ছিল। নন্দন পার্কের অতিথি, গার্মেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক এবং স্থানীয়দের খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডায় মুখর থাকতো। ঘটনার পর থেকে চিরচেনা এই কোলাহল এখন আর নেই। বন্ধ হয়ে গেছে পাঁচ দোকানে কর্মরত ১২ পরিবারের জীবিকাও। মায়ের দোয়া ভাত হোটেলের মালিক শামসুল আলম বলেন, ঘটনার পর আমরা তিন পরিবারের আয়-রোজগারও বন্ধ। না খেয়ে থাকার অবস্থা।
স্থানীয়রা জানান, ঘটনার দিন পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য একাধিকবার ওই এলাকায় অভিযান চালায়। একদিন পর মধ্যরাতে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় পুলিশ ওই স্থান থেকে অনেককে আটক করেন। তবে শুভেচ্ছা হোটেলের মালিক মন্টু ও তার ভাই শওকত, বাসের লাইনম্যান ওমর ফারুক, স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম জালাল ও তার স্ত্রীকে এখন ছেড়ে দেয়া হয়নি। তারা এখনও পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.