ত্বকী হত্যার বিচার- এক দেশে দুই দৃষ্টান্ত কেন? by রফিউর রাব্বি

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী
৮ নভেম্বর সিলেটের ১৪ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজন ও খুলনার ১২ বছরের শিশু রাকিব হত্যার বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডে ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ৮ জুলাই রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আর ৩ আগস্ট রাকিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৭ কার্যদিবসে রাজন হত্যার বিচার ও ১০ কার্যদিবসে রাকিব হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ রাজনকে হত্যার পরে ঠিক চার মাসের মাথায় বিচার সম্পন্ন করা হলো আর তিন মাস পাঁচ দিনের মাথায় রাকিবের বিচার সম্পন্ন করা হলো। এটি সরকারের একটি নজিরবিহীন কাজ। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কতগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের যেমন উত্তর তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি নতুন করে কতগুলো প্রশ্নেরও জন্ম হয়েছে।
রাজনের মূল ঘাতক কামরুল ইসলাম সৌদি আরব পালিয়ে গেলেও তাঁকে ফিরিয়ে এনে বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো সরকার যদি ইচ্ছা করে তাহলে দ্রুততম সময়ে যেকোনো বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব। এখানে মূল বিষয়টি হলো সরকারের সদিচ্ছার বিষয়। সরকার সে বিচারটি সম্পন্ন করতে চায় কি না? গত ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শিশু নির্যাতন একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এমন অপরাধে জড়িত কেউই রেহাই পাবে না’ (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৫)। এরপরই রাজন ও রাকিবের এ রায়, যা প্রধানমন্ত্রীর কথার বাস্তবায়ন বলেই আমরা মনে করি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় কেন? ত্বকী হত্যার তিন বছর হতে চলল, এখন পর্যন্ত হত্যার অভিযোগপত্র দিয়ে এর বিচার শুরু করা গেল না কেন? সংগত কারণেই প্রশ্নটি এখন সবার মনেই উত্থাপিত। ত্বকী হত্যার বিষয়টি কি এমনই জটিল যে এর রহস্য ভেদ করা যাচ্ছে না বা এর ঘাতকদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না? না, তা নয়। কারণ দুই বছর আগেই ত্বকী হত্যার তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সংবাদপত্র ও বিভিন্ন টেলিভিশনের মাধ্যমে গোটা দেশবাসীকে জানিয়েছে কারা, কখন, কবে, কোথায়, কেন ও কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে। ত্বকীর ঘাতক হিসেবে তারা যাদের নাম উল্লেখ করেছে, তারা সবাই সরকারদলীয় লোক। তাহলে কি এ জন্যই ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে না? রাজন ও রাকিবের ঘাতকেরা যেহেতু তেমন প্রভাবশালী বা সরকারদলীয় নয়, দ্রুত বিচারের জন্য তাই এ দুটো হত্যাকাণ্ডকেই বেছে নিয়ে এক নতুন নজির স্থাপন করা হয়েছে?
ত্বকী হত্যার তিন বছর হতে চলল, এখন পর্যন্ত হত্যার অভিযোগপত্র দিয়ে এর বিচার শুরু করা গেল না কেন? সংগত কারণেই প্রশ্নটি এখন সবার মনেই উত্থাপিত। আমরা চাই না এক দেশে দুই আইন ও নিয়ম চলুক আমাদের দেশের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার মধ্যে যোগ্য ও দক্ষ বহু কর্মকর্তা রয়েছেন। যাঁরা অতি দ্রুতই অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের রাজনীতি অনেক সময় তাদের স্বাধীন গতিকে বাধাগ্রস্ত করে। ত্বকী হত্যার পরে দুজন ঘাতক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ত্বকী হত্যার এক বছর না যেতেই এ হত্যার তদন্তকারী সংস্থা হত্যার তদন্ত সম্পন্ন করে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। গত বছর ৫ মার্চ তারা সংবাদমাধ্যমে ত্বকী হত্যার খসড়া অভিযোগপত্র প্রদান করে অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে বলে জানিয়েছিল। অথচ অদ্যাবধি সে অভিযোগপত্র পেশ করা হলো না।
ত্বকীর হত্যার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তরা সরকারদলীয় হওয়ার কারণেই এ হত্যার অভিযোগপত্র আটকে আছে বলে আজ অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু আমরা তো এ প্রশ্নবিদ্ধ বিচারব্যবস্থা চাই না। রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে দেশের প্রতিটি নাগরিক সুবিচার পেতে চায়। এটি তাদের শেষ ভরসার জায়গা। একদিকে আজ রাজনের ঘাতককে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে এনে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার নজির, অপরদিকে ত্বকী হত্যার মূল ঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তি দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীর সামনে, নাকের ডগায় প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়ানোর নজির! এখানে প্রশ্ন হচ্ছে সদিচ্ছার। এ বিচারটি সরকার করতে চাইছে কি না।
৯ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন রাকিব ও রাজনের মতো অন্যান্য চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে (প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০১৫)। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা যেন বাস্তবে পরিণত হয়। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী যেন ত্বকীর ঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কারণ, আমরা চাই না এক দেশে দুই আইন ও নিয়ম চলুক।
রফিউর রাব্বি: নিহত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা।

No comments

Powered by Blogger.