বাঘের গুহার সামনে আমরা সবাই একা! by ফারুক ওয়াসিফ

সবাই মহাবিপদের ভয় করছেন। ভয়টা অমূলক নয়। নিহত প্রকাশক দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের পর এত ভয় আমি কখনো পাইনি।’ হয়তো এটাই মানুষের মনের কথা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ২১ আগস্টে বলেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ না থাকলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সৈয়দ আশরাফের দায়িত্ব। কিন্তু দেশবাসীকে এক করবে কে? অধ্যাপক হক বিচার চান না, শুভবুদ্ধির উদয় চান। শুভবুদ্ধির উদয় বলতে তিনি জাতীয় ঐক্যের কথাই বলে যাচ্ছেন। সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে, শোকের জমিনে যে পিতা ঐক্যের বীজ বপন করেন, সেই বীজ ফেটে শান্তির উদয় হতে হলে শুধু দলীয় ঐক্য না, জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবতে হবে। তাই শুধু দলীয় ঐক্যের ডাক দিলেই হবে না, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রূপরেখাও দিতে হবে।
এত হিংসা ও বিভেদ এই দেশে বহুকাল দেখা যায়নি। মানুষ ভরসা ও ঐক্যের দিশা দেখতে চায়। অবিশ্বাসের দেয়াল উঁচু হচ্ছে প্রতিদিন। সমাজে বিশ্বাসে, পরিচয়ে ও মতামতে ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু এখন বিভক্তির পরিখা তৈরি হচ্ছে। তাতে ঢালা হচ্ছে হিংসার তপ্ত গরল। মানুষ খুন হচ্ছে অহরহ। একতা না থাকলে, ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হলে কী পরিণতি হয়, স্বাধীন দেশের তার অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে।
বিপর্যয়ের লক্ষণগুলো দগদগে। একের পর এক লেখক-ব্লগার-প্রকাশক খুন হচ্ছেন অথবা হামলায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকছেন। এগুলো সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ নয়। এগুলোর লক্ষ্য হিংসা ও বিভক্তির দাবানল লাগিয়ে দেওয়া। কোনো হত্যার পরই বলা যাচ্ছে না, এটাই শেষ। সেই ভরসা জাগাতে সরকার ব্যর্থ।
সন্তানের লাশ কাঁধে, শোকের জমিনে যে পিতা ঐক্যের বীজ বপন করেন, সেই বীজ ফেটে শান্তির উদয় হতে হলে শুধু দলীয় ঐক্য না, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। তাই শুধু দলীয় ঐক্যের ডাক দিলেই হবে না, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রুপরেখাও দিতে হবে লেখক ও সাংবাদিক, স্বদেশি ও ভিনদেশি, পুলিশ ও প্রশাসন, সরকারি ও বিরোধী, ডান বা বাম—কে নিরাপদ? কোনো মৃত্যু হয় চাপাতি অথবা গুলিতে, কোনো মৃত্যু হয় বন্দুকযুদ্ধ অথবা ক্রসফায়ারে। কোনো কোনো মৃত্যুর বায়বীয় দায় স্বীকার করার ঘোষণা আসে অনলাইনে। কোনো কোনো হত্যার দায় কেউই স্বীকার করে না। মৃত্যুর আগে কেউ নাস্তিক, কেউ আস্তিক, কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ বাংলাদেশি, কেউ বিদেশি, কেউ ভালো, কেউ মন্দ; কিন্তু হত্যার পরে যে লাশ পড়ে থাকে, তা মানবের। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে, নাগরিক হিসেবে তার হত্যার বিচার লাগবে, নিরাপত্তা দিতে হবে।
আশুলিয়ায় একজন পুলিশ সদস্য হত্যার পর আক্রান্ত হলেই পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের চিন্তাটা আত্মরক্ষার দিকে; জননিরাপত্তার কী হবে? বিপদে তো সবাই! পুলিশের বন্দুকে গুলি থাকে না, মন্ত্রীদের কথা ও কাজে সত্য ও মানবিকতা থাকে না। একদিকে চাপাতি আরেকদিকে ৫৭ ধারা। কথা বলবে কে? ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ করা কি মানবাধিকারের দাবি, নাকি আইনের শাসনের দাবি, অথবা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তার দাবি, তা নিয়ে ভাবার সুযোগই-বা কই? এই সম্মিলিত ভয়ের সঠিক নাম জাতীয় সংকট, অস্তিত্বের সংকট।
ভীত মানুষ সুস্থ চিন্তা করতে পারে না। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের গোলমালে সত্য শনাক্ত করাও কঠিন। অতীত ও ভবিষ্যতের সবকিছুর জন্য যদি ‘কেষ্ট ব্যাটাই’ দায়ী হয়, তাহলে সর্বময় ক্ষমতা নিয়েও কেন পরাস্ত হচ্ছে সরকার? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একমুখে জামায়াতকে দায়ী করেন, আরেক মুখে বলেন জামায়াত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরকারকে অভিযোগের তোপের মুখে রাখাও বিরোধী দলের কৃতিত্ব হতে পারে না। অদূরদর্শী প্রতিরোধের ডাক দিয়ে যে জীবনের অপচয় হলো, তার জবাবদিহি তাদের করতে হবে। এখন কেউ বলছে জঙ্গি, কেউ বলছে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র, কেউ-বা কপাল চাপড়াচ্ছেন। মুশকিল হলো দুটি পক্ষই যার যার শত্রুকে ‘জাতীয় শত্রু’ আখ্যা দিয়ে বসছে। সাবেক এক কুখ্যাত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে: উই আর লুকিং ফর শত্রুজ! অতীতে এভাবে সত্যের বরখেলাপের ফল ভালো হয়নি, ভবিষ্যতেও হওয়ার নয়।
ভয়কে নাম দিতে পারলে তাকে মোকাবিলা করা যায়। শত্রু চিহ্নিত করা গেলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব। নির্ভরযোগ্য নেতা পেলে তাঁর পেছনে দাঁড়ানো যায়। কিন্তু কী সেই ভয়, কোন সে শত্রু, আর কে দেবেন আশা? বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে শত্রুকে মোকাবিলার রাজনৈতিক দিশা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
তখন শত্রুর চেহারা স্পষ্ট ছিল, জাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে একতাও গড়া গিয়েছিল। এখন যখন দেশ দুভাগে বিভক্ত এবং দেশের লোকই দেশের লোকের শত্রু, যখন প্রগতি ও ধর্মের নামে হিংসার আবাদ ছড়ানোর ডিপ পলিটিকস সক্রিয়, তখন ঐক্য আসবে না। যে আগুন জ্বলেছে, তা শিগগির নিভবে না। বদনাম যা হওয়ার হয়েছে, উঠতি বাংলাদেশকে জাগিয়ে রাখতে হলে এখনই যুদ্ধংদেহী মনোভাব ছেড়ে সহযোগিতার পাটাতন তৈরি করতে হবে। গণতন্ত্র ও অধিকারহীন জাতি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কারও পক্ষেই দাঁড়াবে না। ভয় ও হিংসা সমান তালে বাড়বে। রাজনীতি পরিণত হবে অসামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে। অবশ্য লুণ্ঠন-দুর্নীতির তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। অসুবিধা হচ্ছে দেশের জীবন ও সম্পদ নিয়ে।
জঙ্গি জঙ্গি বলতে বলতে সত্যি সত্যি যদি আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ এসে যায়, তার মোকাবিলা কি একা করতে পারবে এই সরকার? ব্যর্থ আন্দোলন দিয়ে, গোঁজামিলের কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে আরও অসহিষ্ণুতার দিকে ঠেলে দিয়ে বিএনপিও পগারপার। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিএনপি বা আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয়-পরাজয়ের অংশ নয়। বরং বাংলাদেশ এক থাকলেই দলগুলো টিকবে। ভালো হোক মন্দ হোক, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের দুটি পা, দাঁড়িপাল্লার দুই পাল্লা। এক পা কাটা হয়ে গেলে কিংবা এক পাল্লা ছিঁড়ে পড়লে বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতা ও ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে।
বিএনপি-লীগ পরস্পরের পাতা ফাঁদে নিজেরাই পড়ে গেছে। দেশভাগের সময় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের শত্রুতা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে ২০০ বছরের দখলদার ব্রিটিশকেই তারা পরম বন্ধু ভেবেছিল। ব্রিটিশের তৈরি দুর্ভিক্ষ ও ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গায় কোটিরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। আজ আওয়ামী লীগের বড় শত্রু বিএনপি, বিএনপির বড় শত্রু আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের চেয়ে বিদেশিদের ওপরই বেশি ভরসা তাদের। এ দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘নিয়ন্ত্রিত’ জামায়াত নিশ্চয়ই মজা পাবে, আর খুশি হবে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়েরা। পরস্পরের জন্য যে খাদ তারা খুঁড়ে যাচ্ছে, তা ডিঙাতে পারবে তো তারা?
আমরা দেখেছি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং বিগত জরুরি অবস্থার সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই নেত্রী একসঙ্গেই নির্যাতিত হয়েছিলেন। যে সমস্যা তাঁরা সৃষ্টি করেছেন, তার সমাধান তাঁদের হাত দিয়ে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এককভাবে কিছু করা খুবই কঠিন। মনের বাঘ বলি বনের বাঘ বলি, বিপদ একটা আছে। বাঘ শিকার নিয়ে একটা গল্প আছে। দুজন শিকারি বন্দুক নিয়ে বনে গেছে বাঘ শিকারে। তো একজন খাদে পড়ে আর নড়েচড়ে না। তখন অপর জন পুলিশে ফোন করে জানতে চাইল, ‘আমার সঙ্গী মনে হয় মৃত, আমি কী করব?’ পুলিশের উত্তর: ‘প্রথমে নিশ্চিত হোন যে আপনার বন্ধু মৃত না জীবিত।’ ফোনের অপর প্রান্তে ‘দুম’ শব্দ শোনা গেল। এবার ফোন কানে নিয়ে শিকারিটি বলল, ‘নিশ্চিত হয়েছি, এবার কী?’
সঙ্গীর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গিয়ে শেষ গুলিটি খরচ করে ফেলেছিল শিকারিটি, আর বাঘের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একা!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.