নাশকতার ছক জামায়াতের by সৈয়দ আতিক

সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নাশকতার পরিকল্পনা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ‘জামায়াত-শিবির’। এজন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকাকে টার্গেট করে একটি ছকও এঁকেছে তারা। এরই অংশ হিসেবে হত্যা করা হয় ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশী নাগরিক ও রাজধানীর গাবতলীর চেক পোস্টে পুলিশ সদস্যকে। এরপর ঘটানো হয় ঢাকার হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া শারদীয় দুর্গোৎসবের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলার পরিকল্পনাও ছিল সরকারবিরোধী চক্রের। কিন্তু এটি ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতায়। এসব ঘটনা ঘটিয়ে ভারতসহ বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করাও তাদের অন্যতম টার্গেট। জামায়াতের এ অপতৎপরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তাদের নাশকতার ছক বাস্তবায়নে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের কাজে লাগানো হচ্ছে।
প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানে এসব তথ্য পেয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা। তবে নাশকতার সঙ্গে জড়িতরা তাদের কৌশল বারবার পাল্টাচ্ছে। কাশিমপুর কারাগারের ভেতর থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি নাশকতা ঘটানোসংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ বাইরে তাদের লোকদের দিচ্ছে বলেও নিশ্চিত হয়েছে বলে দাবি করেছে গোয়েন্দা সূত্র। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যতই কৌশল অবলম্বন করুক না কেন আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা আরও কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে জামায়াত-শিবির এবং তাদের অপ্রকাশ্য গোষ্ঠী জেএমবি-আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এক হয়েছে, এরাই একগোষ্ঠী। তাদের রুখতে কিছু এলাকা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। এসব এলাকায় জামায়াত-শিবির যে নাশকতার ছক তৈরি করেছে তা প্রতিহত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার অভিযোগে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ধরাও পড়ছে। আইনশৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত-শিবির প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু এলাকায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে তাদের নানা পরিকল্পনা। এছাড়া অন্য যেসব এলাকায় নাশকতা ঘটনানোর পরিকল্পনা করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, সাতকানিয়া, বান্দরবান, পর্যটন শহর কক্সবাজারের রামু, রংপুর, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, টঙ্গী, বগুড়ার আদমদীঘি, জয়পুরহাট। পরিস্থিতি সামাল দিতে এসব এলাকায় ঢাকা থেকে আইনশৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকটি টিম গিয়ে সেখানে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। অপরাধীগোষ্ঠী যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তা শনাক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে গেছে তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি ও প্রসিকিউশন) মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবে বড় ধরনের থ্রেট ছিল। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা ও নজরদারির কারণে জামায়াত-শিবির তাদের নাশকতা চালাতে পারেনি। এ গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দেশকে সংকটে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের কোনো চক্রান্ত করে লাভ হবে না। কারণ, গোয়েন্দারা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছেন। জামায়াত-শিবির বা সরকারবিরোধী চক্র পূজায় হামলা করে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা, হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে হামলা করলে ভারতের কাছে বার্তা যাবে যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির তথা স্বাধীনতা বিরোধীগোষ্ঠী নানা কৌশলে নাশকতার চেষ্টা করছে। এসব এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা ও হোসনি দালানের হামলার পর আইএসের দায় স্বীকারের পেছনেও স্বাধীনতাবিরোধীরা কাজ করেছে। পাশাপাশি আইএসের নামে দায় স্বীকারের যেসব বার্তা আসছে, তার পেছনেও একই গোষ্ঠী জড়িত। এদের একটি চক্র পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি তোফায়েল বান্দরবান ও কক্সবাজারে হামলার পরিকল্পনা করছে। তার বাসা থেকে আইএসসংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য উদ্ধার করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। সম্প্রতি এ অভিযানটি পরিচালিত হলেও তা এখনও গোপন রাখা হয়েছে। সূত্রটি জানিয়েছে, তোফায়েল ফেসবুকে একটি ক্লোজ গ্রুপ তৈরি করেছে। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের জামায়াত-শিবিরের নাশকতাকারীদের যোগসূত্রের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রযুক্তিগত মনিটরিংয়ে এসব তথ্য হাতে পাওয়ার পর তা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়কেও অবগত করা হয়েছে বলেও জানায় ওই সূত্র। আরও জানা গেছে, কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবান থেকে তোফায়েল এবং তার একটি বিশেষ চক্র তিনটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করছে। যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আগামীতে যে কোনো সাম্প্রদায়িক কর্মসূচিতে হামলার বিষয়টি এসব সাইটে উল্লেখ আছে। সাইট তিনটি হচ্ছে- নাইক্ষ্যংছড়িবাসী, বান্দরবানবাসী ও রক্তাক্তপ্রান্তর। জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য পাওয়ার পর সোমবার থেকে বিমানবন্দরে সতর্কতার বিষয়ে পুলিশের বিশেষ শাখাকে অবগত করা হয়। তারপরই বিমাবন্দরগুলোতে কড়া তল্লাশি ও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, যে কোনো নাশকতা ঠেকাতে দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারদের কাছেও বার্তা পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি ওই বার্তার বিষয়ে কয়েকজন পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ বিষয়ে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, পূজায় বড় ঝুঁকি ছিল, কিন্তু তা প্রতিহত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এজন্য সাম্প্রদায়িক কমিটি করা হয়েছিল তার জেলায়। তিনি বলেন, জামায়াত নাশকতা চালাতে পারে। এ বিষয়ে তার কাছে বার্তা দেয়া হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বান্দরবানের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, এ এলাকায় জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর নাশকতা প্রতিরোধে বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
দেশে জামায়াত-শিবির অস্থিরতা ও নাশকতার চেষ্টা করছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, এটা ঠিক যে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের অপ্রকাশ্য গোষ্ঠী জেএমবি ও অন্য জঙ্গিরা যোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, জামায়াতের একটা গোপন শক্তি হিসেবে কাজ করে জঙ্গিরা। এটা তাদের অপ্রকাশ্য দিক। আর প্রকাশ্যে জামায়াত রাজনীতি করে। কিন্তু এ গোষ্ঠী রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও নাশকতার ছক করছে। যা এখন আইনশৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।
জেনারেল রশীদ বলেন, এ মুহূর্তে গোয়েন্দাদের পূর্ব সংকেত পাওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। আর তার পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করতে পারলে ঝুঁকি কমে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা, পুলিশ সদস্য খুন, তাজিয়া মিছিলে হামলা একই গোষ্ঠীর কাজ- তাই অভিযুক্তদের কঠোর আইনের মুখোমুখি করতে হবে। আর এর মাধ্যমে তাদের বোঝাতে হবে নাশকতা করলে রেহাই নেই।
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা যুগান্তরকে বলেন, প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি স্থানে নাশকতার ছকের তথ্য সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। এসব এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নাশকতার পরিকল্পনা করছে। তবে কিছু স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের প্রতিহত করা গেছে। তিনি বলেন, কাশিমপুর কারাগারের ভেতর থেকেও বাইরে পরামর্শ পৌঁছানো হচ্ছে। এটিও সরকারসংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত মেটাডাটার মাধ্যমে এ ধরনের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

No comments

Powered by Blogger.