চীন-জাপানের স্মৃতির লড়াই by মনজুরুল হক

স্মৃতি হচ্ছে মানব ইতিহাসের চমৎকার এক সম্পদ। মানুষের স্মৃতিচারণা ইতিহাসের অজানা অনেক ঘটনার ভেতরের কাহিনি আমাদের সামনে উন্মোচন করে দিতে সক্ষম। সেদিক থেকে স্মৃতি আবার মানুষের শত্রুও বটে। অপ্রীতিকর অতীতকে ঢেকে রাখার জন্য স্মৃতি নিধনের খেলাও তাই মানবসভ্যতায় নতুন কিছু নয়। ফলে আগামীর অনাগত প্রজন্মের জন্য স্মৃতিকে ধরে রাখা হচ্ছে ইতিহাসের সঠিক পথের দিশা, ভবিষ্যতের বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য একটি উপায়।
সে রকম ভাবনা থেকেই জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সংগঠন ইউনেসকো ১৯৯২ সালে বিশ্বের স্মৃতি নামের একটি স্মৃতি সংরক্ষণ কর্মসূচি চালু করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের দালিলিক নানা রকম ঐতিহ্য একক একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ করে সারা বিশ্বের জন্য সেগুলোর প্রাপ্তি সহজ করে দেওয়া। প্রকল্পের প্রাথমিক লক্ষ্য ও এর কাঠামো ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৭ সাল থেকে ইউনেসকো নথিবদ্ধ হওয়া সংরক্ষিত স্মৃতির তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করে। সেই তালিকা এরপর থেকে প্রতিবছর দীর্ঘায়িত হয়ে এখন বিশাল এক ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের নানা রকম যেসব উপাদান এখন এতে যুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭ শতকের প্রামাণিক দলিলপত্র থেকে শুরু করে কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ইশতেহারের মূল কপি এবং চিলিতে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার দলিলপত্র অন্তর্ভুক্ত আছে। ফলে বিস্তৃতি আর বিষয়বস্তু উভয় দিক থেকে বিশ্বের স্মৃতি ক্রমেই হয়ে উঠছে অতীতের পৃথিবীকে জানতে পারার নির্ভরযোগ্য এক সূত্র।
বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে পাওয়া সুপারিশ ও সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র পরীক্ষা করে দেখার পর বিশ্ব স্মৃতি প্রকল্পের একটি উপদেষ্টা পরিষদ বছরে একবার নতুন সংযোজনার তালিকা ঘোষণা করে থাকে। এ বছর উপদেষ্টা কমিটির তিন দিনের দ্বাদশ বৈঠকটি বসেছিল আবুধাবিতে চলতি মাসের ৪ তারিখ থেকে। প্রায় ৫০টি নতুন নথিপত্র এবারের বৈঠকে উপদেষ্টা কমিটি অনুমোদন করেছে, সেগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকে জমা দেওয়া বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশিয়া বৈঠকের সংরক্ষিত দলিল এবং সার্বিয়ার পক্ষ থেকে জমা দেওয়া দেশটির বিরুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই পাঠানো টেলিগ্রাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে সব রকম অনুমোদন যে সব সময় সব কটি দেশকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না, সেই প্রমাণও অবশ্য এবারের অনুমোদন অনেক বেশি স্পষ্ট করে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
চীনের পক্ষ থেকে যে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাবলির দালিলিক প্রমাণপত্র বিশ্বের স্মৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এ বছর জমা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে, ১৯৩৭ সালের নানজিং গণহত্যা এবং জাপানের সামরিক বাহিনী ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকের প্রথমার্ধে চীনের বিস্তৃত এলাকা দখল করে নেওয়ার পর সৈনিকদের যৌনসেবা দেওয়ার জন্য যৌনদাসী নামে পরিচিত জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া চীনা রমণীদের বিষয়টি। চীনের এ দুটি মনোনয়ন নিয়েই জাপান অবশ্য শুরু থেকেই প্রবল আপত্তি জানাতে থাকে।
জাপানের অবস্থান হচ্ছে এ রকম যে যৌনদাসীর বিষয়টি বিশ্বজুড়ে যুদ্ধকালীন প্রচলিত থাকা নিয়মের বাইরের কিছু নয় এবং বিশ্বের অনেক দেশই অতীতে তা করেছে। ফলে শুধু জাপানকে দায়ী করা হলে তা পক্ষপাতমূলক হতে বাধ্য। এ ছাড়া জাপান আরও মনে করে যে চীন কিংবা অন্যান্য দেশের সেই সব রমণীকে জোর করে ধরে এনে যৌনদাসী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়নি, বরং অর্থ উপার্জনের জন্য স্বেচ্ছায় তাঁরা সেই পথে পা বাড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে, নানজিং গণহত্যা নিয়ে জাপান সরকার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ইউনেসকোকে জানিয়েছিল যে বেসামরিক কিছু চীনা নাগরিক সেই ঘটনায় নিহত হলেও নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই চীনের দাবি করা তিন লাখের কাছাকাছি নয়। সন্দেহ নেই, অতীতের সেই কলঙ্ককে জাপান কলঙ্ক বলে মেনে নিতে রাজি নয়, বরং অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই জাপানের বর্তমান নেতৃত্ব সেটাকে দেখে থাকে। ফলে কলঙ্কের দায়মুক্ত হতে চীনের সুপারিশ করা বিশ্বের সেই স্মৃতি মনোনয়নের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধে জাপান সরকার অবতীর্ণ হয়।
গত বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে জাপানের সরকারি পর্যায়ের সম্পর্কের ক্রমাবনতি এখন দেশ দুটিকে অনেকটা যেন উত্তপ্ত বাগ্যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে, যার সর্বশেষ উন্মুক্ত প্রকাশ আমরা দেখছি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। স্মৃতি তাই কারও জন্য ইতিহাসের আবশ্যকীয় উপাদান বিবেচিত হলেও কারও কাছে তা যে বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দেয়, জাপানের এই সাম্প্রতিক আচরণ সেই প্রমাণ আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরছে। নানজিং গণহত্যা কিংবা যৌনদাসী—কোনোটাকেই জাপানের ক্ষমতাসীন মহল ঘটে যাওয়া ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। জাপানের এ রকম জোরালো আপত্তির মুখে ইউনেসকোর উপদেষ্টা কমিটি শেষ পর্যন্ত চীনের দুটি সুপারিশ থেকে একটিকে গ্রহণ করে নিয়ে অন্য আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছে। বিশ্বের স্মৃতিতে সর্বশেষ অন্তর্ভুক্ত চীনের সেই সুপারিশটি হচ্ছে নানজিংয়ের গণহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত দলিলপত্র।
তবে জাপান কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আবুধাবি বৈঠকের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পর জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক বিবৃতিতে উষ্মা প্রকাশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ইউনেসকোর বিরুদ্ধে আনা হয়। জাপানে জাতীয়তাবাদী চেতনার নবজাগরণ–প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশের বর্তমান প্রশাসন মনে হয় অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব মেনে নিতে রাজি নয়। জার্মানির দৃষ্টান্ত জাপানের সামনে থেকে গেলেও সেই একই পথে পা বাড়াতে দেশের নেতৃত্ব নারাজ। ফলে ইতিহাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা তুলে ধরাকেই টোকিওর নীতিনির্ধারকেরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। তবে সে রকম অনমনীয় অবস্থান যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়, জাপানের নেতৃত্ব মনে হয় সেটা বিবেচনায় নিচ্ছে না।
নানজিং গণহত্যায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তাই বলে ঘটনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা হলে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি এবং নিপীড়নের শিকার হওয়া একটি জাতির প্রতি অসম্মানই এর মধ্য দিয়ে করা হয়। জার্মানি যেমন নাৎসি অপরাধের জন্য নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেই বসে থাকেনি, বরং আইন করে যেকোনো রকম নাৎসি তৎপরতা দেশজুড়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, জাপানের বেলায় সে রকম কিছুই কিন্তু দেখা যায় না। ফলে যুদ্ধকালীন নেতৃত্বের অপরাধের বিষয়টিও যেন হয়ে ওঠে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আর সে রকম পরিবেশ নতুন করে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে জুগিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় ইন্ধন।
ইউনেসকোর বিশ্বের স্মৃতি প্রকল্পে বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের নানা রকম উপাদান ইতিমধ্যে সংযুক্ত হলেও বাংলাদেশ কিন্তু এখন পর্যন্ত তালিকার বাইরে রয়ে গেছে। এ বছরও কোনো রকম সুপারিশ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি শোষণ ও গণহত্যার বিষয়েও কোনো দলিলপত্র বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বিবেচনার জন্য দাখিল করেনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা না অজ্ঞতা, তা এই নগণ্য কলাম লেখকের বোধগম্য নয়।
তবে আমাদের সেই মহান ঐতিহ্য আর সাম্প্রতিক ইতিহাসের পাশাপাশি অতীতের আরও অনেক কিছু বিশ্বের স্মৃতিতে কীভাবে যুক্ত করে নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরুর প্রক্রিয়ায় মনে হয় আর বিলম্ব করা উচিত নয়।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.