‘গরু বিতর্ক’ এবার দিল্লিতে by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের পর ‘গরু বিতর্ক’ এবার ঢুকে পড়ল খোদ রাজধানী দিল্লিতে। এতে শুরু হলো নতুন এক কেন্দ্র-রাজ্য বিতর্ক।
রাজধানীতে কেরালা সরকারের নিজস্ব ভবনের ক্যানটিনে গরুর মাংস পরিবেশনের অভিযোগ পেয়ে দিল্লি পুলিশ সোমবার সন্ধ্যায় সরাসরি সেখানে গিয়ে রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ভবনের ভেতর ও বাইরে প্রচুর বাহিনীও মোতায়েন করা হয়।
এতে কেরালার কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চণ্ডী আজ মঙ্গলবার দিল্লি পুলিশের এই আচরণের তীব্র সমালোচনা করেন। সমালোচনায় মুখর হন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সবার অভিযোগ, রাজ্য সরকারকে না জনিয়ে রাজ্য সরকারের ভবনে ঢুকে দিল্লি পুলিশ তার ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক এ সমালোচনার মুখে দিল্লি পুলিশ কমিশনার বি এস বাসসি অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা আইন অনুযায়ীই কাজ করেছেন।
দিল্লিতে গরুর মাংস বা ‘বিফ’ বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় মহিষের মাংস। আর সেটা হয় আইন মেনেই। কেরালা ভবনের ক্যানটিনে সোমবারের মেন্যুতে ‘বিফ ফ্রাই’ বলে যা লেখা ছিল তা ওই মহিষের মাংসই। ‘হিন্দু সেনা’ নামে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা মেন্যুতে ‘বিফ ফ্রাই’ দেখে পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশও বিরাট এক বাহিনী নিয়ে ওই ভবন ঘিরে ফেলেন। তারা সরাসরি ক্যানটিনে গিয়ে অভিযোগ নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে। কেরালা ভবনের কর্তারা পুলিশকে জানান, মেন্যুতে বিফ ফ্রাই লেখা থাকলেও মহিষের মাংসই পরিবেশন করা হচ্ছে। সরকার অনুমোদিত কসাইখানা থেকেই তাঁদের মাংস সরবরাহ করা হয়। বেআইনি কিছু করা হচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞাও অমান্য হয়নি।
ক্ষুব্ধ কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চণ্ডী অভিযোগ করেন, দিল্লি পুলিশ তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। তারা রাজ্য সরকারের কর্তাদের জানিয়ে কেরালা ভবনে যেতে পারত। তা না করে রাজ্য সরকারের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দোষী পুলিশদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন ওমেন চণ্ডী।
এদিকে কেজরিওয়াল বলেন, দিল্লি পুলিশ বিজেপি-সেনার মতো আচরণ করেছে। মমতা নিন্দা জানিয়ে টুইটে বলেছেন, মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এ এক অবিবেচক ছক।
অন্যদিকে ‘গরু বিতর্ক’ রাজনৈতিক মোড় নিচ্ছে দেখে দিল্লির পুলিশ কমিশনার তাঁর আচরণের ব্যাখ্যায় বলেন, আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থেই তাঁরা গিয়েছিলেন। দিল্লি এগ্রিকালচারাল ক্যাটল প্রেজারভেশন অ্যাক্ট (১৯৯৪) অনুযায়ী চাষের কাজে ব্যবহৃত গরু বা বাছুর বা বলদের মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ। অভিযোগ পেয়েই তাঁরা তদন্তে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল যাতে এ নিয়ে অশান্তি না ছড়ায়। কেরালা ভবনে যাওয়ার আগে পুলিশ কেন রাজ্য সরকারের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেনি সেই ব্যাখ্যা পুলিশ কমিশনার দিতে পারেননি।
দিল্লির পুলিশ রাজ্য সরকারের অধীনে নয়। তারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আজ্ঞাবহ। এ নিয়ে কেজরিওয়ালের সঙ্গে দিল্লি পুলিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের লড়াই লেগেই রয়েছে। গরু ও গো-মাংস নিয়ে বিজেপি ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সারা দেশে অহেতুক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে বলে কংগ্রেস, বাম ও অবিজেপি দলগুলোর অভিযোগ। দিল্লি পুলিশের এ আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিকেরা আজ মঙ্গলবার কেরালা ভবনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
সেপ্টেম্বর ৩০,বুধবার ২০১৫ -গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে গুজবের পরিণতিতে পিটিয়ে মারা হলো এক মুসলমান বৃদ্ধকে এবং গুরুতর আহত হলেন তাঁর পুত্র। রাজধানী দিল্লি থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে উত্তর প্রদেশের বৃহত্তর নয়ডার বিসাদা গ্রামে গত সোমবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।
প্রতিবাদে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুসলিম প্রধান এক গ্রামের লোকজন বিক্ষোভ জানায়। বিক্ষোভকারীদের দাবি, অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িতে থাকার সন্দেহে মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আপাত শান্ত এই অঞ্চলে এই ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেই বিসাদা গ্রাম ও তল্লাটে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির কোনো ঘটনা ঘটেনি। গ্রামটিও সচ্ছল। নিহত মুহম্মদ আখলাখ (৫৮) শিক্ষিত ও মিশুক বলেই এলাকায় পরিচিত। শুধু তাই নয়, এবার কোরবানির ঈদেও নিহতের বাড়িতে গ্রামের হিন্দু প্রতিবেশীরা এসেছেন এবং পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত এই গ্রামে এমন ঘটনা সবাইকে চমকে দিয়েছে। নিহতের পরিবারের সদস্যরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। আখলাখের মেয়ে সাহিবার মতে, একটা গুজবের ভিত্তিতে শতাধিক মানুষ বাড়িতে চড়াও হয়ে এভাবে তাদের আক্রমণ করবে, কোনো দিন তারা কল্পনাও করেননি।
গ্রামে একটা বাছুর দু দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। সোমবার হঠাৎই গুজব ছড়ায়, আখলাখের জমিতে নাকি গরুর হাড় এবং বাড়ি থেকে গরুর মাংস পাওয়া গেছে।
গুজব ছড়ানোর কিছু পর স্থানীয় একটি মন্দির থেকে উসকানিমূলক কিছু ঘোষণা হয়। তার পরই শতাধিক লোক আখলাখের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা ৫৮ বছর বয়সী আখলাখকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তার ২২ বছরের ছেলে দানিস গুরুতর আহত হন। একলাখের বাড়ির ফ্রিজে ছাগলের মাংস রাখা ছিল। আক্রমণকারীরা সেটাকে গরুর মাংস বলে দাবি করে। পুলিশ সেই মাংস আটক করে। বুধবার নয়ডা প্রশাসন জানায়, আটক মাংস গরুর নয়, ছাগলের।
বিজেপি শাসিত কিছু রাজ্যে গরুর মাংস কেনাবেচার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সমাজবাদী পার্টি-শাসিত উত্তর প্রদেশে গরু জবাই ও মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন ঘটনায় প্রশাসন উদ্বিগ্ন। বিজেপির রাজ্য নেতারা গোটা ঘটনার জন্য রাজ্য পুলিশকে দোষী ঠাওরেছে।
আখলাখের পরিবারেরও অভিযোগ, ঘটনার এক ঘণ্টা পর পুলিশ আসে। বিসাদা গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকায় ৮০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। আহত দানিসের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার রুপি মঞ্জুর করা হয়েছে।
হামলার সময় বাড়িতে থাকা আখলাকের মেয়ে সাজিদা বলেন, ‘ওই রাতে গ্রামের শতাধিক বাসিন্দা আমাদের বাড়িতে আসে। তারা আমাদের বাড়িতে গরুর মাংস রয়েছে বলে অভিযোগ করে এবং দরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করে আমার বাবা ও ভাইকে পেটাতে শুরু করে। তারা আমার বাবাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায় এবং ইট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। পরে আমরা জানতে পেরেছি মন্দির থেকেই আমাদের বাড়িতে গরুর মাংস রয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।’
গৌতম বুদ্ধ নগরের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার কিরন এস জানিয়েছেন, এ ঘটনায় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই মন্দিরের পুরোহিতকে প্রথমে আটক করা হলেও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত আখলাকের ঘর থেকে পাওয়া মাংস গরুর কি না, তা যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

No comments

Powered by Blogger.