কুকুর ও মুগুর by সৈয়দ আবুল মকসুদ

পত্রিকায় খবরটি পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমি লোকটিকে দেখতে যাই। কৌতূহলবশত নয়, সান্ত্বনা দিতেও নয়, একটি লম্পটকে শুধু স্বচক্ষে দেখতে। ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডের একটি বেডে লোকটি শুয়ে ছিল। তার মুখ চাদরে ঢাকা। ও রকম মুখ কেউই মানুষকে দেখাতে চায় না। তার পায়ের কাছে তার স্ত্রী মাথা নিচু করে বসে। তার ক্ষতিও সামান্য নয়।
ঘটনাটি হলো, লোকটির বিয়ের পর থেকেই তার অবিবাহিত শালির ওপর চোখ পড়ে। তাকে কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। ফুসলানোতে কাজ না হওয়ায় সে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতিষ্ঠ হয়ে একদিন শালি সম্মত হয়। লোকটি খুবই খুশি, তবে বুঝতে পারেনি যে শালির হাতে রয়েছে লুকানো নতুন ব্লেড। এক পোঁচ দিয়ে দুলাভাইয়ের যৌনাঙ্গ গোড়া থেকে কেটে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। কর্তিত প্রত্যঙ্গটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ওই ওয়ার্ডে রোগী দেখতে এক বৃদ্ধাও গিয়েছিলেন। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘এই সব ছেলেদের মাদের উচিত জন্মের পরই...কেটে ফেলা।’
মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে ভদ্রমহিলা যৌনাঙ্গের কথ্য শব্দটি বলে ফেলেন। আমি তাঁকে বলতে চেয়েছিলাম, মা জানবেন কীভাবে যে তাঁর পুত্র ভবিষ্যতে শরীরের কোন প্রত্যঙ্গ দিয়ে পৈশাচিক অপরাধ করবে? কিন্তু হাসপাতালের করিডরে হালকা কথাবার্তার পরিবেশ ছিল না।
এভাবে কেউ কারও কোনো অঙ্গ কেটে ফেলা নির্মমতা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো নারীকে ধর্ষণ করা বা ধর্ষণে উদ্যত হওয়া জঘন্য ফৌজদারি অপরাধ। ওখানে দাঁড়িয়ে আমি সেদিন ভাবতে চেষ্টা করি, মেয়েটি এ কাজ না করে আর কী করতে পারত। কার অপরাধ বেশি? লোকটির নাকি তার শালির? মেয়েটি তার বোনের অবিশ্বাসী লম্পট স্বামীকে প্রশ্রয় দিলে কী হতে পারত? তাকে দুলাভাইয়ের লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হতো। এবং লোকটি আরও অনেক মেয়ের সর্বনাশ ঘটাতে পারত। সেসবই গ্রহণযোগ্য হতো, নাকি এই অঙ্গচ্ছেদ সঠিক হয়েছে। আর একটি বিকল্প হতো, মেয়েটি দুলাভাইয়ের লাম্পট্যের কথা তার অভিভাবকদের কাছে প্রকাশ করে প্রতিকার চাইতে পারত। তা মারাত্মক পারিবারিক অশান্তি ডেকে আনত।
নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। কিন্তু বর্তমানে যে উপসর্গ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা হলো, মেয়েশিশুর ওপর পৈশাচিক যৌন নিপীড়ন। গত চার মাসে তিন থেকে আট বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ১৫টি। পত্রপত্রিকায় আসেনি এমন আরও ঘটনা থাকা সম্ভব। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে কয়েকটি শিশু মারাও গেছে।
মারা না গিয়ে যারা বেঁচে আছে, তারাও আমৃত্যু এমন এক বীভৎস স্মৃতি বয়ে বেড়াবে, যা তাদের জীবনকে করে দেবে দুর্বিষহ।
যৌন অপরাধ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন কঠোর আইন তৈরি হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার সরকার শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে নির্যাতনকারীকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নপুংসক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি হবে খুবই উপযোগী।
আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ, ২১ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ প্রোসেতিও জানিয়েছেন, যৌন নির্যাতনকারীদের নপুংসক করে দেওয়ার জন্য সরকার আইন প্রণয়ন করছে। ইন্দোনেশিয়ায় সম্প্রতি মেয়েশিশুর ওপর কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।
ওই দিন প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় এই নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত হয়। অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট যৌন নির্যাতনকারীদের এই শাস্তির আদেশ জারি করবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পার্লামেন্টে কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই এটি আইনে পরিণত হবে। আইনের বিধানে বলা হয়েছে, অপরাধীর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্ত্রী হরমোন ঢুকিয়ে দিয়ে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনকারীকে নপুংসক করে দেওয়া হবে। এই শাস্তি কার্যকর হলে লম্পটেরা ওই জঘন্য অপরাধ করার আগে হাজারবার চিন্তা করবে পরিণতি সম্পর্কে, বলেন প্রোসেতিও।
যৌন নির্যাতনকারীদের নপুংসক করে দেওয়ার শাস্তির বিধান পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশে শিশুর ওপর পৈশাচিকতার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে, তার প্রতিবিধানও হতে হবে কঠোরতর ও দৃষ্টান্তমূলক। প্রথাগত শাস্তি জেলে ঢুকিয়ে এ-জাতীয় অপরাধ দমন সম্ভব নয়। যেমন কুকুর তেমন মুগুর দরকার। আমাদের জনপ্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকেরা যত তাড়াতাড়ি ইন্দোনেশিয়ার মতো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেবেন, বাংলাদেশের মেয়েশিশুদের জন্য তত মঙ্গল। কারণ, বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুলের বিকল্প নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.