হাতকড়া নিয়েই চলছে গুলিবিদ্ধ নয়নের চিকিৎসা by কাজী সুমন

গুলিবিদ্ধ পায়ে ব্যান্ডেজ। এক হাতে হাতকড়া, অন্য হাতে স্যালাইনের ক্যানোলা। হাতকড়া পরিয়ে আনা-নেয়া করা হচ্ছে এক্স-রে কক্ষে। এভাবেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে চলছে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদল নেতা রবিউল ইসলাম নয়নের চিকিৎসা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নয়নের বাম পায়ের ঊরু থেকে শটগানের চারটি গুলি বের করা হয়েছে। তবে এখনও একটি গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, ছররা গুলির খোসাও তার ঊরুর মাংসপেশিতে বিঁধে আছে। এদিকে গুলি বের করতে গিয়ে ঊরুর তিন থেকে চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের মাংসপিণ্ড কেটে ফেলে দেয়া হয়। এতে ওই স্থানে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। একটু নড়াচড়া করতে গেলে টান পড়ছে মাংসপেশিতে। এতে দুজনের কাঁধে ভর করে বাথরুমে যেতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার আটকের পর মগবাজারের একটি হোটেলে নিয়ে তার পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে পুলিশ গুলি করেছে বলে অভিযোগ করেন নয়ন। এতে তার বাম পায়ের ঊরুতে কয়েকটি গুলি বিদ্ধ হয়। এরপর তাকে দ্রুত ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সরজমিন ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নয়নের বেডের চারপাশে ঘিরে আছেন চারজন পুলিশ সদস্য। পালাক্রমে নয়নকে পাহারা দিচ্ছেন তারা। তার এক হাতে হাতকড়া। অন্য হাতে লাগানো স্যালাইনের ক্যানোলা। বাম পায়ে ব্যান্ডেজ। কিছুক্ষণ পরই হাতকড়া পরানো অবস্থায় তাকে নেয়া হয় এক্স-রে রুমে। এরপর তার পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ড্রেসিং করে বেডে আনা হয়। খানিকক্ষণ পর ডিউটিরত এক ডাক্তারের সঙ্গে মৃদু বাকবিতণ্ডা হয় দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যের। ওই ডাক্তার গুলিবিদ্ধ নয়নের হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেয়ার আহ্বান জানান। জবাবে পুলিশ সদস্য বলেন, আপনাদের ওয়ার্ড থেকে একজন খুনের মামলার আসামি পালিয়ে গেছে। তাই ওই আসামির হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে। এর জবাবে চিকিৎসক বলেন, আপনাদের দায়িত্বপালনকারী পুলিশ সদস্যরা চা খেতে যাওয়ার সুযোগে ওই আসামি পালিয়েছে। এখানে আমাদের কোন গাফিলতি ছিল না। ঢামেকের সহযোগী প্রফেসর ডা. মহিউদ্দিনের অধীনে চিকিৎসা চলছে গুলিবিদ্ধ নয়নের। এদিকে চারদিন ধরে ঢামেকেই রাত কাটাচ্ছেন নয়নের বাবা আক্কাস শেখ ও মা শেফালী বেগম। আক্কাস শেখ বলেন, নয়ন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনেই আমরা মাগুরা থেকে চলে আসি। আজ চারদিন ধরে এখানে আছি। তার যাবতীয় ওষুধপত্র ও হাসপাতালের খরচ আমরাই বহন করছি। এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার সুস্থ ছেলেকে পুলিশ গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমি সবার আগে আমার ছেলের দ্রুত সুস্থতার জন্য উন্নত চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। মা শেফালী বেগম বলেন, নয়নকে যখন ড্রেসিং করানো হয় তখন তার চিৎকার আমি সহ্য করতে পারিনি। সারাক্ষণ সে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতো খেতে পারছে না। ওষুধ খাওয়ার আগে সামান্য জুস খেয়েছে।
জানা গেছে, ৮ই অক্টোবর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওইদিনই নয়নের ঊরু থেকে চারটি গুলি বের করা হয়। এরপর তাকে ১০২ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। তখন তার হাতে হাতকড়া ছিল না। কিন্তু গত শনিবার সকালে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে ওই ওয়ার্ড থেকে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় হত্যা মামলার আসামি তাজুদ খাঁ। এরপর রোববার সকাল থেকে গুলিবিদ্ধ নয়নের হাতে হাতকড়া লাগানো হয়। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের ৫ উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে, পুলিশি হেফাজতে অসুস্থ কাউকে নির্যাতন করা যাবে না, কারও সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা যাবে না। একজন রোগীকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা অমানবিক আচরণ। এছাড়া, এটা সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। ২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নির্যাতন আইন-২০১৩) সংসদে পাস করা হয়েছে। ওই আইনেও বলা আছে, কাউকে নির্যাতন করা যাবে না এবং কারও সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা যাবে না। এটা করলে অপরাধ বলে গণ্য হবে। ওই অপরাধে শাস্তিরও বিধান রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.