দেয়ালবিহীন কারাগার

ডাকাতির দায়ে ইতিমধ্যে ৫ বছর জেল খেটেছেন এডউইন ইয়মসম। আরও ১০ বছর সাজা খাটতে হবে তাকে। তিনি বন্দি হলেও, সুইমিং পুলের ধারে তিনি প্রকাশ্যে শিশুদের কাছে চীনাবাদাম ও কুকিজ বিক্রি করেন। অদূরেই কয়েক শ’ বন্দি ধারালো কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছে। ফিলিপাইনের দ্য ইয়াহিগ প্রিজন অ্যান্ড পেনাল ফার্ম হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুক্ত কারাগার। ইটের দেয়ালের বদলে, পুরো কারাগারের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া। প্রবেশপথে একজন রক্ষী বসে থাকেন। তিনি পর্যটক ও বন্দি অপরাধীদের আত্মীয়দের স্বাগত জানান, কোন তল্লাশি ছাড়াই! আল জাজিরায় প্রকাশিত হয়েছে এমন এক অদ্ভুত কারাগার নিয়ে একটি প্রতিবেদন। এ কারাগারে বসতি প্রায় ৩১৮৬ জন বন্দির। পালাওয়ান প্রদেশের রাজধানী পুয়েত্রো প্রিন্সেসা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। কয়েক বছর ধরেই এ কারাগার পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। উপর থেকে জলে ঝাঁপ দেয়ার অসাধারণ কিছু স্থান ও ভূগর্ভস্থ রিভার সিস্টেমের কারণেও অনেক পর্যটক ঘুরতে যান সেখানে। কারাগারের চারপাশে রয়েছে ঘন উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন ও পর্বতমালা। ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতিষ্ঠিত কারাগারটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের চেয়েও আকারে দ্বিগুণ! কারাগারে রয়েছে অপরাধীদের সংশোধন করার অনন্য ব্যবস্থা। এ কারাগারের এক বন্দি, ৩৬ বছর বয়সী এফরেন এসপিনোসা বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে খুন করি। এখানে অন্যান্য কারাগারের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা বেশি। রক্ষীরাও আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। কারাগারের প্রায় ২০০ নিম্ন নিরাপত্তার বন্দি খামার ও অফিস সমপর্কিত কাজ করেন। তারা মধ্যমমানের নিরাপত্তার অধীনে থাকা বন্দিদের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করেন। প্রায় ১ হাজার মধ্যম মানের নিরাপত্তার অধীনে থাকা বন্দি পরে থাকেন নীল রঙের শার্ট। তারা ধান চাষ, নারিকেল উৎপাদন, শস্যক্ষেত্র, সবজি চাষ সহ কারাগারের বিভিন্ন ক্ষেতে কাজ করেন। মাত্র ৩ জন রক্ষীর একটি দল চোর, খুনি ও নিষ্ঠুর বন্দিদের কাজ তত্ত্বাবধান করেন। ওই বন্দিদের কাজ হলো আগাছা পরিষ্কার করা। মাত্র এক ঘণ্টা চেষ্টা করলেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে পালাতে পারে বন্দিরা। কিন্তু বন্দিরা তার পরিবর্তে প্রতিদিন তিনবার করে বন্দি গণনার সময় শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাধীন বন্দিদের আলাদা রাখা হয়। তারা ছাড়া বাকিরা কিছু না কিছু শেখে। যেমন, চাষবাস, মাছ চাষ, বনায়ন, ইত্যাদি। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে অর্থ আয় হয়। বন্দিদের সংরক্ষণের পেছনে যত অর্থ ব্যয় হয়, তা কিছুটা উঠেও আসে কর্তৃপক্ষের। কারাগারের সুপারিনটেন্ডেন্ট অ্যান্টোনিও সি ক্রুজ বলেন, কারাগার করা হয় অপরাধীদের সংশোধন করার জন্য। এ কারণেই এখানকার নিম্ন-নিরাপত্তাধীন বন্দিরা নিজেদের সাধারণ সমপ্রদায়ের অংশ বলেই ভাবতে পারছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য বন্দিদের কেবল শাস্তিমূলক অবস্থায় রাখা নয়। ১৯০৪ সালে এ কারাগার বানিয়েছিল তৎকালীন আমেরিকান উপনিবেশিক সরকার। তখন এ কারাগারে আলাদা করে রাখা হতো সবচেয়ে বিপজ্জনক ফিলিপিনো অপরাধীদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিপাইন স্বাধীনতা পায়। তখন যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছিল, তারা জমির মালিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে বন্দি অবস্থায় তাদের আচরণও এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হতো। ১৯৭০-এর দিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল করা হয়। অনেক অপরাধীর পরিবারকে পেনাল ফার্মে তখন ঢুকার সুযোগ দেয়া হয়। বর্তমানে ২০ জন নিম্ন-নিরাপত্তাধীন বন্দি নিজ পরিবারের সঙ্গে এ কারাগারে বসবাসের সুযোগ পান! মাসপ্রতি ২০০ পেসো আয় করেন অপরাধীরা। মধ্যম মানের নিরাপত্তাধীন বন্দিরা এর চেয়ে অর্ধেক কম কামাতে পারেন। বন্দিদের মর্যাদা নির্ধারণে একটি বোর্ড কাজ করে। তাদের আয়ের একটা অংশ আলাদা করে রাখা হয়। যাতে তারা মুক্তি পেলে কিছু অর্থ পেতে পারেন। সব বন্দিরাই আবার এ কারাগারে থেকেও খুশি নন। ২৯ বছর বয়সী জেফরি কারাগারে পেইন্টিং আঁকেন। সেগুলো বিক্রিও করেন। তিনি নিজের বন্দিত্বকে বৈষম্যমূলক বলে আখ্যায়িত করেন। একটি গাড়িচুরির মামলায় ১৫ বছরের সাজা খাটছেন তিনি। তিনি বলেন, আমি এখানে থাকতে পছন্দ করি না। আমার পরিবার আমার কাছে আসতে পারে না। কারণ, ম্যানিলা থেকে এ দ্বীপ অনেক দূরে। এছাড়া, কারাগারের খাবার স্বল্পতা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে জেফরির। একই কথা বললেন আরাসেলি গাদ্দি (৬২) নামে এক বন্দি। তিনি কারাগারের নতুন নিয়মের সমালোচনা করে বলেন, নিয়মগুলো ক্রমেই কঠিন হচ্ছে। আমার স্বামী এখন আর বাইরে থাকতে পারে না। বন্দিদের পরিবারের জন্য বানানো ছোট ঘরে থাকেন গাদ্দি। যদিও তার স্বামীকে ঘুমাতে হয় ব্যারাকে। ১৯৯৩ সালে এক বন্দির স্ত্রী হিসেবে এ কারাগারে পাড়ি জমান গাদ্দি। প্রথমদিকে তাদের দু’ জনকেই একত্রে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সেখানে তারা ৩ সন্তান ও এক নাতিকে বড় করেন। কিন্তু সে উপায় এখন আর নেই। ফিলিপাইনের অন্যান্য কারাগার থেকে এখানে পালানোর প্রচেষ্টা হয়েছে খুব কম। গত এক দশকে ২০টি পালানোর ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের জুনে ৭ বন্দি সফলভাবে এ কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হন। এরপরই বন্দিদের ব্যারাকের বাইরে ঘুমাতে দেয়ার অনুমতি বাতিল করা হয়। অনেক বন্দি কারাগারের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি নিয়ে অভিযোগ তুলেন। ২০০৭ সালে ফিলিপাইনের ওমবুডসম্যানের একটি প্রতিবেদনে, এ কারাগারে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও ঘুষ লেনদেনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, খামার থেকে বন্দিদের আয় নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব থাকার কথাও উল্লেখ করা হয় সেখানে। এছাড়া, ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাগারে ঢুকতে পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া হলেও তাদের কোন রসিদ দেয়া হয় না। তাই দুর্নীতি এ খাতেও ঘটতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.