শাকুর শাহ্-এর ‘কিংবদন্তি ভাবনা’

ছবির শরীরে লোককলার নানা উপাখ্যান ও অলংকার। টেরাকোটা-ছাঁদের অঙ্কন থেকে শুরু করে, কাটা-ছেঁড়া কাগজ জুড়ে লোকজ-কোলাজ, গ্রামীণ নারীদের নকশিকাঁথার আলংকারিক উপাদান—কী নেই তাতে! তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতির সরল প্রকাশ যেন ডানা মেলেছে উত্তর-আধুনিক শিল্পভাবনার সঙ্গে। দুইয়ে মিলে আমাদের দিচ্ছে ভিন্ন এক ভুবনের সন্ধান। আবদুস শাকুর শাহ্-এর চিত্রসৃজন সম্পর্কে এ কথা তো বলাই যায়। তাঁর সৃষ্টি সমাহারে হাজার বছরের লোকায়ত বাংলার সংস্কৃতি ও লোকমুখে প্রচলিত গীতিকাব্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। ৯ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে ‘মিউজ অব মিথ’ অর্থাৎ ‘কিংবদন্তি ভাবনা’ শিরোনামে খ্যাতিমান এ শিল্পীর একক চিত্র প্রদর্শনী। এটি তাঁর ২২তম একক প্রদর্শনী। কাগজ ও ক্যানভাসে কোলাজ, জলরং আর অ্যাক্রিলিক রঙে সাম্প্রতিক কালে আঁকা ৪৮টি চিত্রকর্ম জায়গা পেয়েছে এবারের প্রদর্শনীতে। শাকুর শাহ্-এর জন্ম ১৯৪৬ সালে বগুড়ায়। ১৯৭০ সালে ঢাকায় তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন স্নাতক পাঠ। ১৯৭৭-৭৮ সালে পড়েছেন ভারতের বরোদার মহারাজ সোয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় শিক্ষক হিসেবে সান্নিধ্য পেয়েছেন গুণী শিল্পী কে জি সুব্রামানিয়ানের। মূলত তাঁরই উৎসাহে বরেণ্য অগ্রজ যামিনী রায়, কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরীদের চর্চিত লোকজ ঐতিহ্যনির্ভর চিত্র নির্মিতির পথে পা বাড়িয়েছেন শাকুর শাহ্। তবে এ নির্মাণে যেমন ঐতিহ্যনির্ভরতা মূর্তমান, তেমনি নিজস্ব কৌশলে শাকুর এর মধ্যে পুরে দিয়েছেন আধুনিকতা ও স্বক্রিয়তা—তথা শাকুরীয় ভঙ্গিও। গত শতকের নব্বই দশক থেকে তাঁর চিত্রপটে উঠে আসতে থাকে লোককাহিনির চরিত্ররা। এরই ধারাবাহিকতায় মৈমনসিংহ গীতিকার নদের চাঁদ, মহুয়া, মলুয়াসহ প্রাণীচরিত্রের দেহাবয়বকে সরল অঙ্কনরীতিতে তুলে ধরার কৌশল বাংলাদেশের চারুশিল্পচর্চায় শাকুরকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। চিত্রপটে এসব চরিত্রের পাশাপাশি তাদের আখ্যানের গীতিকবিতা থেকে আহরিত অংশবিশেষের লিপিকলার প্রয়োগে শাকুর শাহ্-এর চিত্রপট হয়ে উঠেছে বাঙালির স্বরূপ চেতনার অন্যতম অনুঘটক।
মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করে এখন আলোচ্য শিল্পী আমাদের দেশের প্রচলিত আরও নানা লোকজ ফর্ম আধুনিক কায়দায় উপস্থাপন করছেন, যা জায়গা পেয়েছে চলমান এই প্রদর্শনীতে। কাগজ কেটে, গামছা ও কাপড়ের টুকরো জোড়া লাগিয়ে ছোট আকৃতির নানা কোলাজ কাজের পাশাপাশি গোয়ােশ তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে লোকজ সংস্কৃতির প্রতি নিজের ভালো লাগাকে আবার যেন নতুন করে উন্মোচন করতে চেয়েছেন শাকুর। ‘ঐতিহ্য’ শিরোনামে করা নতুন এ নির্মিতিতে চার-পাঁচটি সমান্তরাল প্যানেলে নকশার সরল সৌকর্য তুলে ধরেছেন নকশিকাঁথার ধরনে। তবে গড়নে-গঠনে এবং বর্ণ প্রকরণে এখানে স্পষ্ট আধুনিকতার ছাপ। সরলতার অসীম সৌন্দর্য অবলোকনের প্রাঞ্জল চোখ আমাদের সামনে খুলে দিয়েছেন শাকুর শাহ্। প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিনে শিল্পীর ভাষ্য, ‘আমি চেয়েছি সহজকে সহজে আঁকতে। সোজাসাপটা করে বলতে চেয়েছি, ধরতে চেয়েছি আমার দেশের অসম্ভব সুন্দর লোকজ গীতিকাব্যের চরিত্রের নান্দনিকতাকে। এগুলো দেশে ও দেশের বাইরে আমার দেশ ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরে মানুষের কাছে।’ এবারের কতগুলো ছবিতে শাকুর শাহ্-এর বর্ণ প্রলেপ বেশ উষ্ণ। ‘রূপবতী’, ‘বন্ধু’ ও ‘গ্রামীণ গাথা’ শিরোনামে আঁকা কয়েকটি ছবির আবহে কমলা ও হলুদাভ রং ভারী করে প্রয়োগ করেছেন শিল্পী। আর এর মাধ্যমে লোকশিল্পীর রঙের উজ্জ্বলতাকে যেন আরও শক্তি ও সাহসের সঙ্গে ব্যবহার করলেন শাকুর। এই প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের নতুনত্ব মূলত এটিই। আর অন্য বাদবাকি ছবির উপস্থাপনায় ফুটে উঠেছে শিল্পীর সেই চিরচেনা ধাঁচ। শেষে বলি, চিরকালীনতার নিরিখে আবদুস শাকুর শাহ্ আমাদের শিল্পকলার ইতিহাসে অনিবার্য হয়ে রইলেন, আজ এ কথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৯ অক্টোবর।

No comments

Powered by Blogger.