শিশুশ্রমের ঘামে দামি প্রসাধন

ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের খনি এলাকায় শিশুশ্রমিকদের
পাথর ভেঙে অভ্র আহরণ। ছবি: এএফপি
‘আমি তো স্কুলে যেতে চাই, কিন্তু ঘরে খাবারই নেই, আবার স্কুল! কাজেই আমাকে কাজের কাছেই ফিরে আসতে হয়।’
আট বছরের ছোট্ট শিশু ললিতা কুমারী এভাবেই জানায় তার কচিমনের কষ্টের কথা। তার সারা মুখ ধুলোয় ভরা, ঘামে লেপ্টে আছে চুল। এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একমনে সে এমন এক খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করে চলেছে, যা দিয়ে তৈরি করা হয় নেইলপলিশ ও লিপস্টিকের মতো সাজসজ্জার উপকরণ।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ঝাড়খন্ড রাজ্যের খনিতে ললিতা আরও অনেক শিশুশ্রমিকের সঙ্গে যে কাজটি করে, তা হচ্ছে খনিজ পদার্থ মিকা বা অভ্র আহরণ। রাজ্যের প্রায় হাজারো শিশু এভাবে অভ্র আহরণ করে পরিবারে জীবিকার উপায় করে দিচ্ছে। পাউডার, লিপস্টিক ও নেইলপলিশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধন সামগ্রীর উপাদান এই অভ্র।
ললিতা কুমারী জানায়, খনিজ পাথর ভেঙে অভ্র আহরণ ছাড়া জীবনে আর কিছু থাকতে পারে বলে জানা নেই তার। চার বছর বয়স থেকেই সে জীবনে একটা বিষয়ই জেনেছে, তা হলো পাথর ভেঙে অভ্র সংগ্রহ করা।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, পরিবেশ দূষণের কারণে দুই দশক আগে রাজ্য সরকার খনি বন্ধ করে দিলেও হাজার হাজার টন খনিজ পাথর রয়ে গেছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা একবেলা পেটপুরে খাওয়ার আশায় সেই পাথর ভেঙে অভ্র সংগ্রহ করছে। ল’রিয়েল ও রেভলনের মতো প্রসাধন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অল্প দামে সেই অভ্র কিনে নিয়ে মেয়েদের রূপ সুন্দর করার প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করে।
রাজ্যের একজন অধিকার কর্মী জানান, গ্লিটার, পাউডার, মাসকারা ও লিপস্টিক তৈরিতে অভ্র ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের দামি ব্র্যান্ডের প্রসাধন সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অল্প দামে এই খনিজ উপাদান লুফে নেয়। রাজ্যের ছোট ছোট শিশু হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে অভ্র সংগ্রহ করে তা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। পরে ওই ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের কাছে তা সরবরাহ করেন।
পাথর ভেঙে অভ্র আহরণ। ছবি: এএফপি
২০০৯ সালে শিশুদের শ্রমে মিকা সংগ্রহ করে তা ল’রিয়েল ও রেভলনের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করার দায়ে জার্মান প্রতিষ্ঠান মেয়াখের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘২০০৯ সালের পর থেকে মিকা সংগ্রহে এই প্রতিষ্ঠান শিশুশ্রম বন্ধ করে দিয়েছে।’
তবে ওই অধিকার কর্মী বলেছেন, রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সব সময় পর্যবেক্ষণ করাটা অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে না যে, মিকা সংগ্রহে শিশুশ্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বাচপান বাঁচাও আন্দোলনের কর্মী ভুবন রিভু বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে দায় এড়াতে পারে না। এটা আসলে সবার সমষ্টিগত দায়িত্ব, এই অঞ্চল থেকে যারা মিকা সংগ্রহ করবে, শিশুদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি তারাই নিশ্চিত করবে।
ভারতের প্রচলিত আইনে শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছরের নিচে। এই বয়সের কেউ শ্রম দিলে তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে, যা অবৈধ। কেউ এই অবৈধ কাজে উৎসাহ দিলে ভারতীয় আইনে তার জেল-জরিমানা হবে। তবে এই আইন এখনো কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা নেই।
ললিতার মতো শিশুরা কাজ করতে করতে প্রায়ই ধারালো যন্ত্রে হাত-পা কেটে ফেলে। খনিজ ধুলোবালিতে দেখা দেয় শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা। বর্ষাকালে খনি এলাকায় সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। এ থেকে সর্পদংশনেরও ঝুঁকি থাকে। খনিজ পাথরের স্তূপ ধসে অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে।
জেলা শ্রম তত্ত্বাবধায়ক রাম বচন পাসোয়ান বলেন, ‘যেসব এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেশি, সেসব এলাকার শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে তাদের বাবা-মাকে বোঝানো অনেক কঠিন। এ ছাড়া কাগজে-কলমে এখানকার এই খনির কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই এখানে আমাদের আইনি কাজ করাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং।’
ঝাড়খন্ড রাজ্যের চার সন্তানের বাবা শিবু যাদব বলেন, তাঁর সন্তানেরা খনিতে কাজ করে পরিবারটিকে টিকিয়ে রেখেছে। তাঁর চার সন্তান মিকা সংগ্রহ করে মাসে এক হাজার রুপি আয় করে। তিনি বলেন, ‘এটাই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উৎস। যদি তারা এ কাজ না করে, তাহলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.