বিজ্ঞান গবেষণায় আমরা কেন পিছিয়ে আছি by এস এম মুজিবুর রহমান

২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে নানা পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, হচ্ছে ও ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২৯ জুন প্রথম আলোর সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট’। এতে বলা হয়েছে ১০০-এর কাছাকাছি বিভাগ ও ইনস্টিটিউশনের গবেষণার জন্য ধরা হয়েছে মাত্র সাড়ে চার কোটি টাকা, যা কি না পুরো বাজেটের ১ শতাংশ মাত্র। টাকার এই পরিমাণটা শুধু অপ্রতুলই নয়, একধরনের মশকরা আরকি! প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নাম শুনলে যাঁরা খােমাখাই উদ্বেলিত হন, তাঁরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেটে খুবই মনঃক্ষুণ্ন² হবেন। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেটের এই করুণ অবস্থা, সেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাটা কেমন হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা বাজেট প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ডিগ্রি দেওয়া নয়, বরং জ্ঞান সৃষ্টি, নিরন্তর অনুশীলন গবেষণা’ এই লাইনটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণের উপায় নেই। তবে গবেষণা বাজেটের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আসলেই শুধু ডিগ্রি দেওয়া, সৃজনশীল গবেষণা নয়। এই ধারণা মিথ্যা হলে আমি খুবই খুশি হতাম, কিন্তু সেটা হওয়ার নয়। যাক এবার একটি আনুমানিক সংখ্যায়নে আসা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট চার কোটি টাকা ও অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট ২ দশমিক ৫ কোটি টাকা হলে দেশের সর্বমোট ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট হবে মাত্র ১২ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা শ্বেতহস্তী বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন ও বিসিএসআইআরসহ অন্যান্য খুচরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট ৪৮ মিলিয়ন ডলার হলে বাংলাদেশের সর্বমোট গবেষণা বাজেট হবে ৬০ মিলিয়ন ডলার। এখন LHps://em.wikipedia.org/wiki থেকে নেওয়া একটি উপাত্ত থেকে কয়েকটি দেশের তালিকায় নমুনা তুলে দিচ্ছি; এই তালিকায় ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই!
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একটি লজ্জাজনক অবস্থায় আছে।
আজ বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে, এটা আমাদের সবার জন্যই কিছুটা হলেও আনন্দের। তবে গড় আয় আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে অনেকটাই শুভংকরের ফাঁকি বলে ধারণা করি। স্বল্পসংখ্যক ধনী মানুষের আয় আর বিশালসংখ্যক দরিদ্রের আয় গড় হিসাবে চালানোতে বড় ধরনের একটা ফাঁক থেকেই যায়। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আজ ১ টাকা গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করলে আগামী দিনে ১০ টাকার সংস্থান হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা আমাদের আগামী দিনের পরিকল্পনা তৈরি করেন, তাঁদের বোধের ওপরই নির্ভর করে আমাদের সার্বিক উন্নয়ন।
বাংলাদেশে মেধাবী লোকবলের অভাব নেই। মেধাবী এই লোকবলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মধ্যম আয়ের দেশ হতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না, অন্যথায় এটা একটা ফাঁপা স্লোগান হয়েই থাকবে।
প্রসঙ্গত, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ দিই (এটা অনুমান করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই যে ভারত সব দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে, বরং এর কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় বাংলাদেশ সব দিক দিয়েই এগিয়ে আছে)। স্বাধীনতা লাভের বহু বছর আগে থেকেই তৎকালীন কংগ্রেস দলীয় ভিত্তিতেই ‘প্ল্যানিং কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করে, যা তাদের স্বাধীনতার পর ‘প্ল্যানিং কমিশন’-এ রূপ নেয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই উল্লিখিত প্ল্যানিং কমিটির মাধ্যমে নেহরু মোটামুটিভাবে ভারতের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একটি রূপরেখা ঠিক করে রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, ওই কমিটিতে তৎকালীন ভারতের নামকরা পণ্ডিত ব্যক্তিত্বদের আধিক্য ছিল, আমলাদের স্থান প্রায় ছিলই না বলা যায়। যতটা জানা যায়, ভবিষ্যৎ এই রূপকল্পে বিজ্ঞানের গবেষণা ও উন্নয়নে: (ক) ভারতের পারমাণবিক কমিশন গঠন ও এর কার্যক্রম চিহ্নিতকরণ, (খ) আইআইটিগুলোর রূপকল্প তৈরি করা, (গ) খাদ্যে ভারতের স্বনির্ভরতা অর্জন ও (ঘ) বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়ন রূপকল্পের একটা কাঠামো তৈরি করা। তৃতীয় বিশ্বের একটি উদাহরণ হিসেবে ভারতকেই নেওয়া যেত পারে, যার উন্নয়নে বিজ্ঞান গবেষণা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। বছর কয়েক আগে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির চুক্তি করতে গিয়ে অকপটে বলেছেন, ভারতের সফট ও জাপানের হার্ডওয়্যারের মিলন হলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। আজ থেকে ৭০ বছর আগে ভারতের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বিশ্বপ্রযুক্তিতে একটি প্রজ্ঞাবান রূপকল্পের জন্ম দেয়, যার ফল ভারত আজ ভোগ করছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রায় সাড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এক বড় আকারের বাজেট দিয়েছে বাংলাদেশ ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের জন্য। নিম্ন মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে এই বাজেট নিতান্ত কম নয়। তবে গবেষণা ও উন্নয়নে এই বাজেটের শতকরা কত অংশ ধরা হয়েছে তার সঠিক হিসাব আমার জানা নেই, তবে আমরা এই লেখার গোড়ার দিকে উল্লিখিত তা যদি ৬০ মিলিয়ন ডলার হয়ে থাকে, তবে ৩৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের এই বাজেটের একেবারেই নগণ্য অংশ সেটা। আর ১৫০ বিলিয়ন জিডিপির তুলনায় তা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি!
আমরা জানি, নিম্ন মধ্যম আয়ের এই বাংলাদেশে স্বাভাবিক কারণেই আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যে আমাদের ঠিক করতে হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। ২০১৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই আমাদের আগামী দিনের রূপকল্পে যেসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো: (ক) বায়বীয় অর্থে নয়, যথার্থেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে আয়ের উন্নত মানের কৃষি গবেষণা চালু করতে হবে। সাম্প্রতিক কালে পত্রপত্রিকায় পচা গমের খবরে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এখনো আমরা হইনি। গোলাভরা ধানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে কৃষি, মৎস্য ও আমিষ খাবারের উৎপাদন যথার্থই বাড়াতে হবে উন্নত মানের গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে। (খ) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবস্থা ততটা ভালো নয়, যতটা আমরা প্রচার করি। বিশেষ করে বিদ্যুতের জন্য পারমাণবিক শক্তির বিকল্প দেখি না। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ—এসব একান্তই জোড়াতালি, এগুলো দিয়ে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের চাহিদা পূরণ হবে না। কাজেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আমাদের দক্ষ জনবল চাই। এই দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তি ধার করে চলবে না, তা তৈরি করতে হবে আমাদেরই। কিন্তু এই জনবল ও প্রযুক্তি সৃষ্টির কোনো রূপকল্প আমাদের আছে কি? আমাদের বড় আকারের বাজেটে আছে কি তার জন্য কোনো বরাদ্দ? (গ) স্বাধীনতার প্রায় ৪৪ বছর পরও বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষ হাঁচি-কাশির চিকিৎসার জন্য উড়ে যাচ্ছেন ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর। কেন আমরা পারিনি চিকিৎসাক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরি করতে? গবেষণা-উন্নয়নে কী পরিমাণ বাজেট ধরা আছে চিকিৎসাক্ষেত্রে? সরকারের উচ্চপর্যায়ের ও উচ্চ আয়ের মানুষেরা যেখানে উচ্চমূল্যে বিদেশে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের কথাও ভাবতে হবে। (ঘ) ৫০ বছর আগে ভারত তাদের আইআইটিগুলো চালু করে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় রেখেছে, আজ তার ফল তারা পাচ্ছে। ভারতের আইআইটি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় এক পাল্লায় মাপা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হওয়ার পরও কি আমাদের এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উদয় হবে না? (ঙ) আজ বাংলাদেশে ৩৭টি সরকারি ও ষাটেরও বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমরা ধরে নিই, আমার উল্লিখিত (ক থেকে ঘ) বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের মূল ভূমি হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরুণ ও প্রবীণ গবেষকদের একটি মিলনক্ষেত্র কি ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ (এনআইএসটি) নামের বহুমুখী গবেষণাগার করা যায় না, যেখানে গবেষকেরা আসবেন, প্রশিক্ষণ নেবেন ও দেবেন বছরব্যাপী? ইতালির ত্রিয়েস্তে শহরে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে অধ্যাপক আবদুস সালাম বিজ্ঞানের বিশেষ শাখায় গবেষকদের যে মিলনক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আজ তার সুফল পাচ্ছে। একই রূপকল্পে সদিচ্ছা থাকলে আমরাও পারি জাতীয় পর্যায়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান করতে, যা আমাদের ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে বিজ্ঞান গবেষণায় এগিয়ে নেবে।
আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে মেধাবী লোকবলের অভাব নেই। মেধাবী এই লোকবলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মধ্যম আয়ের দেশ হতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না, অন্যথায় এটা একটা ফাঁপা স্লোগান হয়েই থাকবে।
এস এম মুজিবুর রহমান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়, মাসকাট, ওমান।

No comments

Powered by Blogger.