সত্য বাবুর মৃত্যু এবং... by অমিত রহমান

পাক্কা দুই বছর পর লিখছি। বন্ধুবান্ধব,  শুভাকাঙ্ক্ষী এমনকি সহকর্মীরাও মানা করেন। বলেন, কি দরকার ঝুঁকি নেয়ার। এখনতো ঝুঁকি নানা কিছিমের। লিখে কি হবে? কেউ কি শুনে? অনেক তো লেখা হলো। বলা হলো। দেশ-বিদেশ থেকে কত কিছুই বলা হচ্ছে। কেউ তো আমলেই নিচ্ছে না। তাই না লেখাই ভাল, বিপদ ডেকে আনার চেয়ে। তাদের কথা শুনে লেখাই বন্ধ করে দিলাম। বাহবাও পেলাম অনেকের কাছ থেকে। কেউ কেউ বললেন, কিছুদিন বিশ্রামে থাকেন। দেখেন না কি হয়। আবার অনেকেই বললেন, টকশোতে গিয়ে অনেকে নীতিকথা বলেন বা বলার চেষ্টা করেন। লিখছেন না কেন? সামাজিক নেটওয়ার্কেও তো লিখতে পারেন। অন্যরা তো লিখছে। তাদের বলি, ফেসবুকে আমার অ্যাকাউন্টই নেই। ইচ্ছে থাকলেও খুলি না। এতে ভাল আছি। আজগুবি খবর শুনে আৎকে উঠি না। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা খোঁজার চেষ্টা করে অযথা সময় নষ্ট করি না। উত্তেজনা ছড়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখি না। যাক গে, ওসব কথা বলে লাভ নেই। সাংবাদিকতা যদি করতে হয় তাহলে লিখতে হবে। এতে কেউ খুশি হবেন কেউবা হবেন বিরক্ত। কারও পক্ষে গেলে বস্তুনিষ্ঠ, আর বিপক্ষে গেলে একদম বিরোধী শিবিরভুক্ত। ইদানীংতো একটি বিশেষ দলের তকমা পাওয়া যায় সহজেই। এ জন্য অবশ্য আমরা সাংবাদিকরা অনেকখানি দায়ী। আমরা নিজেদেরকে দলের বাইরে রাখতে পারিনি। দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। কিছু পেয়ে আবার অনেক সময় পাওয়ার আশায়। এতে করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন নানা প্রশ্নের মুখে। প্রয়াত মূসা ভাই বলতেন, যখন কলম হাতে নিই তখন আমার সামনে গোটা বাংলাদেশ। দলমত এখানে নেই। যা সত্য তাই লিখবো। যদি না পারি তাহলে ভাববো আমি কম্প্রোমাইজ করছি। এখানে কম্প্রোমাইজ বলতে বোঝায়, আমি নিজেকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারিনি। সত্য যদি না বলতে পারি তাহলে সাংবাদিকতা না করে আলু-পটলের ব্যবসা করাই ভাল। মূসা ভাই দলের লোক হয়েও কোনদিন সত্যের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সত্য বলে গেছেন। টেলিভিশন টকশোতে এসে স্বার্থের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেননি। সত্য নির্মম, নিষ্ঠুর। মূসা ভাই আমাদের শিখিয়ে গেছেন সত্য বলতে না পারলে চুপ করে বসে থাকো। দেখবে সময় তোমাকে বাধ্য করবে কথা বলতে বা লিখতে। প্রয়াত আরেকজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ফয়েজ ভাই তো ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’ শিরোনামে বই লিখে গেছেন। তিনি মারা গেছেন অনেকদিন হয়ে গেল। অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়ে বই লিখেছেন। এখন বেঁচে থাকলে কি লিখতেন তা আল্লাহ মালুম। তবে অনুমান করি, চুপ করে বসে থাকতেন না। এই দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে আছে। নব্বই দশকে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখন দুই নেত্রী নিরাপদ দূরত্বে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। জনদাবি ছিল দুই নেত্রীকে এক করার। অন্তত এক টেবিলে বসানোর। দেশী-বিদেশী অনেক চেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন শ্রদ্ধেয় ফয়েজ ভাই উদ্যোগী হয়ে সফল হয়েছিলেন। তখনও সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনীতি ছিল। নোংরা দলবাজি ছিল না। কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই তাকিয়ে দেখছি। কিছু বলছি না। লিখছি না। বিদেশী গণমাধ্যমের মূল্যায়ন ছেপে নিজেদেরকে ধন্য ভাবছি। তা-ও আবার সবাই নয়। ক্রিকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মুখের ওপর আমরা অনেক কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু আমরা যে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেরাই বলেছি- এখানে জঙ্গি আছে।
যাই হোক, মূসা ভাই বা ফয়েজ ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। যে দিন খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সংলাপ প্রস্তাবকে শর্তের জালে আটকে দিলেন, সেদিন মূসা ভাই বলেছিলেন, এ কি করলেন খালেদা। সুযোগ হাতছাড়া করে দিলেন! হতে পারে এটা ছিল কূটচাল। তাতে কি? আরেকটা চাল তিনি দিতে পারতেন। দাবার গুটি তো চলমান থাকে না। রাজার সামনে যখন আর চাল থাকে না তখন তো কিস্তিমাত। নতুন করে খেলতে হয়। দাবার পরিভাষায় যাকে বলা হয় চেকমেট। শেখ হাসিনা এক চালেই সব উড়িয়ে দিতে পারবেন তিনিও হয়তো তখন ভাবেননি। কথাও নয়। কারণ রাজনীতি বড় জটিল। মুহূর্তেই রঙ বদলায়। বলে রাখা ভাল, আওয়ামী লীগের নেতারাও দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অনেকেই পরিবারের অনেক সদস্যকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কানাডার বেগমপাড়ার খ্যাতি সেখান থেকেই। প্রশাসনিক অনেক কর্মকর্তার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, নেতাদের ছিল অন্তহীন ভাবনা। যদি খালেদা রাজি হয়ে যান। আর বলেন, আমি সংলাপে রাজি। নির্বাচনেও যাবো। তবে শর্ত হচ্ছে নির্বাচনটা হবে জাতিসংঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। তখন শেখ হাসিনা বিপদেই পড়ে যেতেন। চেকমেট হয়ে যেতো সরকার। দুনিয়াকে কি বোঝাতেন শেখ হাসিনা। দেশের মানুষও বলতো, খালেদা রাজি হয়েছেন তার অধীনে নির্বাচনে যেতে। জাতিসংঘের কথা নাকচ করতেন কিভাবে। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা এখন বলছেন, হাসিনা ঠিকই জানতেন খালেদা তার প্রস্তাবে রাজি হবেন না। কারণ, বিএনপির ভেতরে আওয়ামী লীগের অনেক শেয়ার হোল্ডার রয়েছেন। যারা শেয়ার হোল্ডার নন, তারা ভূমিকা রাখবেন। ঠিকই রেখেছিলেন। এখন তো বিএনপি নেতারাই কবুল করেন একবাক্যে। সে জন্যই হয়তো জীবনের অনেক ঝুঁকিপূর্ণ চালটা হাসিনা দিয়েছিলেন। একেই বলে রাজনীতি। এ যেন চার গোলে হেরে খেলায় ফিরে আসার এক অনন্য নজির। সেদিন গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়েছিল। কেউ কেউ বলেন মহাসংকট। এই সংকট থেকে কে উদ্ধার করবে? রাষ্ট্রের বিবেক বলে যারা পরিচিত তারা কি করবেন? তারা কি নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন। একটা দেশ যখন রাজনীতিশূন্য হয়ে যায় তখন বিপদ আসতে থাকে চারদিক থেকে। সবকিছু রাজনীতিকদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরিণতি কি হয় আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করছি দেশে দেশে। দিনের শেষে নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমাদের নাগরিক সমাজ বিভাজনের কবলে পড়ে একদম কাবু। অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে তারা অন্ধকারকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.