ভারতের আজ্ঞাবহ হবো না : - পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্দ

পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্দ
ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (এম)-ইউএনপিএন মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে বেশি পরিচিত। দলটির প্রধান পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্দ নেপালের একজন আলোচিত রাজনীতিবিদ। রাজতন্ত্র অবসানের পর প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে তিনি হন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর সাথে বিরোধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক টানাপড়েনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে একপর্যায়ে তারই ডেপুটি বাবু রাম ভট্টরাই দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত মাওবাদী নেতা ভট্টরাইয়ের সাথে তার রাজনৈতিক মতপার্থক্য একেবারে অপ্রকাশ্য ছিল না। বিবিসি নেপালি সার্ভিসের রবীন্দ্র মিশ্রের সাথে পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্দের এই সাক্ষাৎকারে নেপালের নতুন সংবিধান গ্রহণ ছাড়াও ভট্টরাইয়ের বিষয়ও উঠে এসেছে। এই সাক্ষাৎকার যখন প্রকাশ হচ্ছে তখন ভট্টরাই মাওবাদী দলের সাথে তার সম্পর্ক ছেদ করেছেন। তিনি নতুন রাজনৈতিক শক্তির পত্তন ঘটাতে চান। কতটা এ ক্ষেত্রে সফল হবেন এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে প্রচন্দের। মাওবাদী নেতা প্রচন্দের এই সাক্ষাৎকার খুব বড় পরিসরের না হলেও নেপালের সঙ্কটময় পরিস্থিতি বোঝার জন্য এটির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য নেপালি টাইমস পত্রিকা থেকে সাক্ষাৎকারটির অনুবাদ করেছেন মাসুমুর রহমান খলিলী
বাবু রাম ভট্টরাই
বিবিসি নেপালি সার্ভিস : আপনি দেশকে প্রজাতন্ত্র করা, গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন, ফেডারেল ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা তৈরির মতো যুদ্ধের প্রায় সব উদ্দেশ্য অর্জন করেছেন। এরপর আপনার জন্য কী কাজ বাকি আছে বলে মনে করছেন?
পুষ্প কমল দাহাল : গণপরিষদে যখন নতুন সংবিধান গৃহীত হয় তখন আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। সেই রাতে আমি যখন বাড়ি পৌঁছি তখন আমার নিরাপত্তা কর্মকর্তা সিংহ দরবার, বালুওয়াটার ও ব্যানশোর বা এ ধরনের কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু আমি তাকে বলি এখন মৃত্যুকে আমার আর কোনো ভয় নেই। আমি এখন শান্তিতে বিশ্রাম করতে পারি, কারণ নেপাল একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে এবং নতুন অভিযাত্রা শুরু করেছে আমাদের প্রিয় দেশটি।
মিশ্র : নেপালের রাজনৈতিক রূপান্তরের একটি পর্ব হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু এটি এখনো একটি অনুন্নত দেশই রয়ে গেছে। আপনার মিশন কি সত্যিই শেষ হয়ে গেছে?
দাহাল : কিন্তু এই রাজনৈতিক রূপান্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত ছিল।
মিশ্র : আপনি আমাদের সম্প্রতি বলেছেন, অন্তত সাত-আট বছর ধরে আপনি সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতে চান। এই সময়ে আপনি নেপালে কী হিসেবে অবদান রাখতে চান?
দাহাল : হ্যাঁ, আমি মনে করি অন্তত আরো সাত-আট বছর ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে হবে আমাকে। আমি পরবর্তী নির্বাচনে জিততে চাই যাতে সংবিধানের ফেডারেল প্রদেশের সৃষ্টি এবং এর বাস্তবায়নে যে ব্যবস্থা রয়েছে সেই রাজনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার বিষয়টিতে তত্ত্বাবধান করতে পারি।
মিশ্র : এসব কাজ করার প্রয়োজনে কি আপনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হবে না?
দাহাল : আমি এই মুহূর্তে কোনো পদ নিয়ে চিন্তা করছি না। কিন্তু আমি এটা স্পষ্ট করতে চাই যে, আমাদের দলকে আগামী জোট সরকারের অংশীদার হতে হবে।
মিশ্র : তাহলে বাবুরাম ভট্টরাই শিগগিরই পার্টির সভাপতি হওয়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না?
দাহাল : আমি পার্টির নেতত্বে হস্তান্তর করার ওপর একটি প্রস্তাব প্রস্তুত করেছি। আমার সক্রিয় রাজনীতিতে থাকার জন্য পার্টির সভাপতি থাকতেই হবে এমন নয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমি এক্ষুনি পদত্যাগের জন্য তৈরি হয়ে আছি।
মিশ্র : ভট্টরাই একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি গঠনের প্রতিজ্ঞার কথা বলেছেন। তিনি আপনাকে তার পার্টি ছাড়ার ব্যাপারে কিছু বলেছেন কি?
দাহাল : তার নতুন রাজনৈতিক শক্তি তৈরির বিষয়টি একটি পুরনো গল্প এবং আমি মনে করি না তিনি দল থেকে বিদায় নেবেন। আমি বিস্মিত হই যখন দেখি তার পর্যায়ের একজন নেতা নতুন সংবিধানের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে কথা বলছেন এবং লিখছেন। এটা আমার কাছে একেবারে অস্বাভাবিক মনে হয়।
মিশ্র : এটি সম্ভবত এ কারণে হচ্ছে যে, তিনি দল থেকে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন?
দাহাল : যদি তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে তিনি কিংবা দেশ কেউই তার কাজ থেকে উপকার পাবে না। আমি ৩০ বছর ধরে তাকে সাথে নিয়ে কাজ করছি। আমার চেয়ে কেউ তার অধিক ঘনিষ্ঠ নেই। তার অনেক গুণ আছে কিন্তু তিনি এক জটিল চরিত্রের ব্যক্তি।
মিশ্র : আপনি প্রকাশ্যে বলেন, ভারত যদি আমাদের সম্মান চায় তাহলে আমাদেরকেও তাদের সম্মান করতে হবে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় বিশেষ দূত এস জয়শঙ্করকে আপনি কী বলেছেন?
দাহাল : আমি সম্প্রতি যখন নয়া দিল্লি যাই তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছি আমরা ভারতের ভালো বন্ধু হতে চাই, ইয়েস ম্যান বা আজ্ঞাবহ নয়। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি এবং সেভাবে যাতে তারা কাজ করে। নয়াদিল্লিতে যাদের সাথে কথা হয়েছে তাদের আমি বলেছি নেপাল ভালো প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের উদ্বেগের সুরাহা করতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই আজ্ঞাবহ হিসেবে নয়।
মিশ্র : আসলে আপনি এবং জয়শঙ্করের মধ্যে কী কথা বা বাক্য বিনিময় ঘটেছিল?
দাহাল : তিনি আমাকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, সবার সম্মতি না থাকলে ভারত নতুন সংবিধানকে স্বাগত জানাবে না। তিনি আরো বলেছেন, কয়টি দেশ স্বাগত জানাল সেটি কোনো বিষয় নয়, ভারতের স্বীকৃতি ছাড়া নেপালের নতুন সংবিধান একেবারে অর্থহীন হবে। আমি শুধু তাকে বলেছি, আপনার সফরটি বড় অসময়োচিত হয়ে গেছে, আপনার হয় ১৫ দিন আগে অথবা ১৫ দিন পরে নেপালে আসা উচিত ছিল।
মিশ্র : এখন মাধেশি দলগুলোর সাথে কিভাবে আপনি মোকাবেলা করবেন?
দাহাল : আমরা শুধু মাধেশিই নয়, থারু ও জনজাতির ক্ষোভ নিরসনের জন্যও সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা রেখেছি। এটি আমরা দ্রুত করে ফেলতে চাই। কারণ যেকোনো বিলম্ব এখন যে গতি এসেছে তা নষ্ট করে দিতে পারে। আমি যখন মাধেশি নেতাদের সাথে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকে বসেছি তখন তারা আমাকে বলেছেন তাদের নির্বাচনী এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে এ সংবিধান অনুমোদন তারা করবেন না। কিন্তু তারা আমাদেরকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছেন।
মিশ্র : আপনি কি তরাই অঞ্চলে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন?
দাহাল : তরাই অঞ্চলে একদল স্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে চাইছে, কিন্তু এটি মাধেশি জনগণের দৃঢ় কোনো সমর্থন পাবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাধেশি জনগণ নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। নেপালি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য অত্যন্ত গভীর ও সুদৃঢ়।
মিশ্র : আপনি কি মনে করেন ভারত তরাই অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে উসকানি দেবে?
দাহাল : আমি এ সম্পর্কে একটু চিন্তিত। ভারতীয় বিশেষ দূত জয়শঙ্করের সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে বলেন, তরাইয়ের অস্থিরতা বিহার, উত্তর প্রদেশ ও ভারতের পুরো সীমান্তে ছড়িয়ে যেতে পারে। তিনি সীমান্ত শব্দটি উচ্চারণ করেন। আমি তাকে বলি, আপনার উদ্বেগ জেনুইন, কিন্তু ভারতের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভারতের নিজস্ব সীমানা ছাড়িয়ে ভাবা এবং বৃহত্তর নেপালের বিষয়টি চিন্তা করা।

No comments

Powered by Blogger.