কোকেন পাচারের কেন্দ্র: আলোচনায় বাংলাদেশ by হাসান ফেরদৌস

ভয়াবহ মাদকদ্রব্য কোকেনের অবৈধ পাচারে এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল না। কিন্তু সেটি বদলাতে পারে। জুনের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামে বলিভিয়া থেকে আমদানি করা সূর্যমুখী তেলের ব্যারেলে বিপুল পরিমাণ তরল কোকেন ধরা পড়ার পর তেমন লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই অভিমত জাতিসংঘের মাদকবিরোধী সংস্থা অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএন ওডিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই পাচারের ব্যাপারে তদন্তে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
প্রথম আলোর কাছে এক লিখিত মন্তব্যে এই সংস্থার একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ১৯৯০-২০১৩ সালে কোকেন পাচারের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৫৫। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই সময়কালে বাংলাদেশে ধরা পড়েছে, এমন পাচার করা মোট কোকেনের পরিমাণ মাত্র ১৩ দশমিক ৮৬ কিলোগ্রাম।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার পাচার করা কোকেনের কোনো হিসাব দেয়নি। তবে নিজস্ব সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি দুবাই পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ঢাকার একটি হোটেল থেকে দক্ষিণ আমেরিকান এক নাগরিকের কাছ থেকে দুই কিলোগ্রাম পরিমাণ কোকেন জব্দ করে। বিশ্বের অন্যত্র ধৃত কোকেন পাচারের ঘটনায়ও বাংলাদেশের নাম এসেছে কয়েকবার। যেমন ২০১২ সালে ভেনেজুয়েলার পুলিশ ২ দশমিক ৫৫ কেজি কোকেন জব্দ করে। সে দেশের পুলিশের ভাষ্যমতে, এই কোকেন বাংলাদেশে পাচারের কথা ছিল। এর আগে ২০১১ সালে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার পুলিশ বাংলাদেশ থেকে ডাক মারফত পাঠানো শূন্য দশমিক ৮০৬ কেজি কোকেনের একটি প্যাকেট জব্দ করে। আরও আগে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা ১ দশমিক ১৫ কেজির একটি চালান ব্যাংককের বিমানবন্দরে আটক করা হয়।
ইউএন ওডিসি মনে করে, এ বছরের জুনে চট্টগ্রামে ধরা পড়া কোকেনের পাচার থেকে মনে হয়, মাদক পাচারের মধ্যবর্তী ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ বাড়ছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশে ক্রমবর্ধমান হারে কোকেন পাচারের যে লক্ষণ, এই সম্ভাবনা তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ধরা পড়া কোকেনের পরিমাণ আশির দশকে যেখানে গড়পড়তা ছিল ২৮ কিলোগ্রাম, সেখানে নব্বইয়ের দশকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২৪ কিলোগ্রাম। চলতি শতকের প্রথম ১০ বছর (২০০০-২০১৩ সাল নাগাদ) সেই পাচারের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৮ কিলোগ্রাম। অবশ্য এই সময়কালে বিশ্বে জব্দ হওয়া কোকেনের পরিমাণ ছিল বহুগুণ বেশি, প্রায় ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৭ কিলোগ্রাম।
৬ জুন ২০১৫-তে চট্টগ্রামে বলিভিয়া থেকে আমদানি করা সূর্যমুখী তেলের পিপায় যে তরল কোকেন ধরা পড়ে, তা পরিমাণের দিক দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু প্রথম পিপা থেকেই ৬০ কেজি শুদ্ধ (পিওর) কোকেন ধরা পড়ে। মোট ১০৭টি পিপায় এই তেল আমদানি করা হয়, যার প্রতিটিতেই অল্প-বিস্তর কোকেন থাকতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে, যার পরিমাণ কমপক্ষে ১৮৫ কেজি। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, এটি এশিয়ার কোনো দেশে আটক তরল কোকেনের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ চালান। সর্ববৃহৎ পাচারটি ছিল ২০১০ সালে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে ধরা পড়া সুরিনাম থেকে আসা ২২৬ কেজির একটি চালান।
ইউএন ওডিসি প্রথম আলোকে জানিয়েছে, চট্টগ্রামে আটক করা কোকেন চিহ্নিতকরণ ও পরিমাণ নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ সরকার এই সংস্থার সাহায্য চেয়েছে। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি বাংলাদেশকে তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উদ্যোগ (ইন্টারন্যাশনাল কোলাবরেটিভ এক্সারসাইজ) ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচির (ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটি এশিউরেন্স প্রোগ্রাম) সদস্যপদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ইউএন ওডিসির নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে আটক করা কোকেন পরীক্ষার জন্য যেকোনো সময়ে নমুনা পাঠাতে সক্ষম হবে।
প্রথম আলোকে এ তথ্য দিয়েছেন ইউএন ওডিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের প্রধান ক্রিশ্চিনা আলবারতিনি। নয়াদিল্লিতে তাঁর দপ্তর থেকে এক লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও জানান, জাতিসংঘের মাদকবিরোধী এই সংস্থা ২০১৪ সাল থেকে বিশ্ব শুল্ক সংস্থার (ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন) সঙ্গে যৌথভাবে তাদের কনটেইনার কন্ট্রোল কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাচার করা মাদকদ্রব্য চিহ্নিতকরণে সহায়তা করে আসছে। এই সহযোগিতার অধীনে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কনটেইনার কন্ট্রোল ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। জাতিসংঘের এই অঙ্গ সংস্থা বাংলাদেশকে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নজরদারিতেও সাহায্য করে আসছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.