বাংলাদেশ বাবাকে মনে রেখেছে by প্রণব ভৌমিক

উদয় শঙ্কর
ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের পথিকৃৎ বলা হয় নৃত্যাচার্য উদয় শঙ্করকে। তিনি তাঁর নতুন ধারার নৃত্য দিয়ে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে পুরো ইউরোপ ও আমেরিকা মাতিয়েছিলেন। তাঁরই কন্যা মমতা শঙ্কর কথা বলবেন তাঁর সম্পর্কে! এমন লোভনীয় সংবাদ অনেককেই গতকাল টেনে নিয়ে গেল গুলশানে, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। সাড়ে ছয়টার অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা, তাঁর কিছু পরেই অতিথিরা এলেন। ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান, লুবনা মারিয়াম প্রমুখ। প্রথমেই দেখানো হলো উদয় শঙ্করকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র, শুক্লা দাশ পরিচালিত দ্য পাওয়ার অব ডান্স। বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ও মা হেমাঙ্গিনী দেবীর সাত সন্তানের প্রথমজন উদয় শঙ্কর। বাঙালি জমিদার বাবা তাঁর এ সন্তানকে এতটাই ভালোবাসতেন যে রাজস্থানের যে শহরে উদয় জন্মেছিলেন, পরে তাঁর নাম করে দেন উদয়পুর। শ্যাম শঙ্কর লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টসে ছেলেকে পাঠান পেইন্টিং শেখাতে, কিন্তু বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভার সংস্পর্শে এসে উদয় বেছে নেন নাচ। প্রামাণ্যচিত্রে উদয় শঙ্কর সম্পর্কে এত কিছু জেনে দর্শক যখন বিমোহিত, তখন মঞ্চে উঠেই মমতা শঙ্কর বললেন তাঁর আফসোসের কথা। বললেন, তাঁর বাবা যে এত বড় নৃত্যশিল্পী, তা তিনি বেঁচে থাকতে বোঝেনইনি। তাঁর কাছে উদয় শঙ্কর ছিলেন কেবলই বাবা! এতটাই ভালোবাসা ও স্নেহ তিনি মমতাকে দিয়েছিলেন। পরে মা অমলা শঙ্করের মাধ্যমেই তিনি উদয় শঙ্করকে জানতে পারেন। মমতা বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে উদয় শঙ্করকে মনে রেখেছে, ভারতে সেভাবে তাঁকে মনে রাখা হয়নি। একটি মঞ্চের নামও তাঁর নামে কেউ করেনি। যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এখানকার মানুষের মধ্যে, সেখানে এটা দেখা যায় না।
বাবা উদয় শঙ্করকে নিয়ে কথা বলছেন মমতা শঙ্কর -প্রথম আলো
তিনি বলে চলেন, উদয় শঙ্কর কেবল নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এত বিনয়ী, মাটির কাছাকাছি, যে তাঁর পরিবেশনা সাধারণ দর্শক থেকে বোদ্ধা—সবাই বুঝতে পারতেন। নাচ কেবল তাঁর বিনোদন ছিল না, এটা বুদ্ধি ও আত্মারও খোরাক জোগাত। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। যেকোনো কিছু থেকেই তিনি নাচের অসাধারণ মুদ্রা বের করতে পারতেন। উদয় শঙ্কর কখনো ধর্মীয় আচারে বিশ্বাস রাখতেন না, কিন্তু নাচই ছিল তাঁর কাছে আরাধনার মতো। ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু পৈতে কেবল নাচের সময়ই পরতেন। তিনি যখন নাচতেন, মনে হতো শিব নাচছে। সমসাময়িক নৃত্য নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে মমতা শঙ্কর বলেন, সমসাময়িক বলতে সবাই এখন পূর্বের ও পশ্চিমের নাচের ফিউশন বোঝে, যেটা খুবই ভুল কথা। উদয় শঙ্কর কখনোই পাশ্চাত্যকে নকল করেননি, তিনি কেবল তাদের উপস্থাপনাটুকু নিয়েছেন। যেমন করে মৌমাছি সমস্ত ফুল থেকে রস আহরণ করে, কিন্তু মধুতে সে ফুলগুলোর কোনোটার গন্ধ মেলে না। মমতা শঙ্কর বলে চলেন। কিন্তু এই এক সন্ধ্যায় কি সব বলা যায়? তাই কথা শেষ হলেও অতৃপ্তি থেকেই যায়।

No comments

Powered by Blogger.