মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন: পলিতে ভরে গেছে জমি বসতভিটা, পুকুর by সুমেল সারাফাত

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন করা পলি ও পানিতে
একাকার বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার হুড়কা
গ্রামের বসতভিটা। বিআইডব্লিউটিএ নির্দিষ্ট জায়গায়
পলি না ফেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। -প্রথম আলো
মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন করা পলিতে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার হুড়কা ও চাড়াখালী গ্রামের বসতভিটা, কৃষিজমি, পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ নির্দিষ্ট জায়গায় পলি না ফেলায় (ডাম্পিং) এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
হুড়কা গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গত বছর রামপালে কুমারখালী নদ থেকে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খননকাজ শুরু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরপর তারা বিভিন্ন জায়গায় পলি ফেলা শুরু করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এ চ্যানেলের হুড়কা-চাড়াখালী গ্রামসংলগ্ন স্থানে খনন শুরু করে বসুন্ধরা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড। এরপর সঠিকভাবে বাঁধ না দিয়ে নদীর পাড়ে খাসজমি-সংলগ্ন এলাকায় পলি ফেলতে থাকে তারা। এভাবে হুড়কা ও চাড়াখালী গ্রামের প্রায় ২০০ একর জমি লবণ ও বালুমিশ্রিত পলিতে ভরে যায়। এতে দুই গ্রামের তিন শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, পুকুর-ঘাট, চিংড়িঘের ভরাট হয়ে যায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর পাড় থেকে শুরু করে হুড়কা ও চাড়াখালী গ্রামের প্রায় পুরোটাই বালু দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন চিংড়িঘের ও ফসলি জমিগুলো এখন ধু ধু বালুচর। লবণ ও বালুর কারণে বাড়ির সামনের সব গাছ মরতে শুরু করেছে।
চাড়াখালী গ্রামের মুদির দোকানি সুশান্ত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘সরকারি জমিতে নির্দিষ্ট করে পলি না ফেলে খননকারীরা আমাদের দুটি গ্রাম পলি দিয়ে ভরাট করে দিয়েছে। এতে প্রত্যক্ষভাবে তিন শতাধিক এবং পরোক্ষভাবে আরও দুই শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও বাড়িতে পুকুর নেই। গাছপালা সব মরতে শুরু করেছে। চিংড়ি ও কাঁকড়ার ঘেরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। ফসলি জমিতে বালু ফেলায় তাতে ধান হবে না। আমরা সম্মিলিতভাবে জেলা প্রশাসক, ইউএনও, স্থানীয় সাংসদ, এমনকি বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে কোনো প্রতিকার পাইনি।’
হুড়কা গ্রামের বিধবা জ্যোৎস্না (৬৫) জানান, তাঁর ২ বিঘা ১০ কাঠা ফসলি জমি ছিল। সেখানে চিংড়িঘের করে দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার চলছিল। কিন্তু পলি ফেলায় তার ঘের এখন বালুতে পরিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমার একটা ছুয়াল প্রতিবন্ধী। আমি নিজি একজন বয়স্ক মানুষ। কী এরে তিন বেলা খাব? বালি পইড়ে ঘরের খুঁটি নড়বড়ে হইয়ে ঘরডা ভাইঙ্গে পড়িছে। রাস্তার পাশে ছোট্ট এই ঘরে কী মানুষ থাকতি পারে? সরকার কী আমাগে দিক একটু দ্যাখপে না।’
চাড়াখালী গ্রামের কৃষক মহানন্দ মণ্ডল (৬০) বলেন, ‘আমার তিন বিঘা ফসলি জমিতে চিংড়ি চাষ করে বছরে ৬০ হাজার ও ধান থেকে ২৫ হাজার টাকা পেতাম। সব শেষ।’
হুড়কা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পার্থ প্রতীম বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা বাধা দিয়েও পলি ফেলা (ডম্পিং) ঠেকাতে পারিনি। স্থানীয় সাংসদ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিতে বলেছেন। মাত্র ৩২ জনের নাম পেয়েছি। সরকার ক্ষতিপূরণ দিলে জমিতে আবার পলি ফেলবে বা জমি অধিগ্রহণ করবে—এ আশঙ্কায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতির কথা চেপে রাখছেন।’
বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এইচ মো. ফরহাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের ওই অংশে খননকাজ করেছিল বসুন্ধরা ড্রেজিং। দ্রুত কাজ করায় কিছু ক্ষতি হয়েছে। ডাম্পিং করার আগে আমরা যে সুরক্ষা দেয়াল (গাইড ওয়াল) নির্মাণ করেছিলাম, সেটিও পর্যাপ্ত ছিল না। কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে বলেছি। তালিকা চূড়ান্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.