এ ঘটনায় মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি কমতে পারে

এই বয়সেও সইতে হলো এমন শোক! মাদারীপুর সদর
উপজেলার বাসিন্দা কাঞ্চন বিবির নাতনি স্কুলছাত্রী
সুমাইয়া আক্তারকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
সেই শোকে তাঁর দুই চোখে অশ্রুধারা।
মস্তফাপুর গ্রামের বাড়ি থেকে তোলা ছবি
ফুটফুটে দুটি মেয়ে। স্কুলের পোশাক পরা। একজনের মাথায় লাল ক্লিপ, আরেকজনের চুল খোলা। শিক্ষকেরা স্কুলের কম্পিউটার থেকে ছবি দুটি বের করে রেখেছেন। গণমাধ্যমকর্মীরা এসে শুধু ছবি দুটিই চাইছেন। এ দুটি ছবি মাদারীপুর সদরের মস্তফাপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার ও হ্যাপি আক্তারের। এই দুজনকে দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের পর বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। এই দুই ছাত্রীর করুণ মৃত্যু স্থানীয় বাসিন্দাদেরও কাঁদিয়েছে। শঙ্কায় বুক কাঁপছে কন্যাশিশুদের অভিভাবকদের। স্থানীয় শিক্ষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, এ ঘটনা বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতির হার কমিয়ে দিতে পারে। মফস্বলের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে দুজনই। সুমাইয়ার বাবা বিল্লাল শিকদার চায়ের দোকান চালান। আর হ্যাপির বাবা হাবিব খান ভাগ্য বদলাতে এক বছর আগে বাহরাইনে পাড়ি দিলেও পরিবারটিকে সচ্ছলতা এনে দিতে পারেননি। এখনো তাঁর প্রবাসযাত্রার খরচই ওঠেনি বলে জানান তাঁর স্বজনেরা। একই গ্রামে সিকি কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ওদের বাড়ি। গত শুক্রবার দুপুরে সুমাইয়াদের বাঁশ-টিনের বাড়িটা ছিল লোকে লোকারণ্য। কাদা কাদা হয়ে গেছে উঠানটা। অন্ধকার ঘরের বিছানায় বসে খুব নিচু গলায় বিলাপ করছেন সুমাইয়ার দাদি কাঞ্চন বিবি। খুব বেশি কান্নাকাটি করার মতো সুস্থ নন ৮০ পার করা কাঞ্চন বিবি। চোখেও দেখতে পান না। সেই চোখের নিচে পানির ধারা। তাঁর ছবি তোলার জন্য কয়েকজন সংবাদকর্মী ঘরে ঢুকতেই একজনকে খপ করে জড়িয়ে ধরে এই বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি আপনার পায়ে ধরি। আমার নাতিনরে আইনা দেন।’
এই নাতনির চোখ দিয়েই পৃথিবীকে দেখতেন কাঞ্চন বিবি। নাতনিই তাঁকে খাওয়াত, এটা-সেটা বলত। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই নাতনি পড়তে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। শুক্রবার দুপুরে নীল পলিথিনে মোড়ানো সুমাইয়ার লাশ এসেছে বাড়িতে। স্বজনেরা ভেবেছিলেন, কাঞ্চন বিবিকে জানাবেন না সুমাইয়ার খুন হওয়ার খবরটি। কিন্তু তিনি যে ক্ষণে ক্ষণে নাতনিকে খোঁজেন।
আর হ্যাপিদের বাড়ির উঠোনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কান্নাকাটি করছেন স্বজনেরা। হ্যাপির মা থানায় আর বাবা বিদেশে। হ্যাপির মা অসুস্থ ছিলেন। বৃহস্পতিবার বাড়িতে রান্না হয়নি। দুপুরে পান্তা ভাত খেয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য বের হয় হ্যাপি। বাড়িতে ফিরে রান্না করার কথা ছিল। কিন্তু বাসায় এসেছে নীল প্লাস্টিকে মুড়ে। সুমাইয়াদের বাড়ির উঠোনে ভিড় করা নারীরা বলাবলি করছিলেন, তাঁদের শিশুরা এরপর ঠিকঠাকমতো স্কুলে যেতে পারবে তো!
স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা আঁখি আক্তার বলেন, এ ঘটনা তাঁদের আতঙ্কিত করেছে। আঁখির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুমাইয়ার সহপাঠী মিম জানায়, তারা এত দিন নির্ভয়েই স্কুলে যাওয়া-আসা করেছে। এ ঘটনা শোনার পর থেকে তার অভিভাবকেরা তাকে একা কোথাও যেতে দিচ্ছেন না।
সুমাইয়া-হ্যাপিরা যে স্কুলে পড়ত, সেই মস্তফাপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বোরহান খান বলেন, তাঁর স্কুলের ১ হাজার ৭৪৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৭৮ জন ছাত্রী। কোনো ছাত্র কোনো ছাত্রীকে বিরক্ত বা উত্ত্যক্ত করছে অভিযোগ পেলে শিক্ষকেরা দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবককে ডেকে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্কুলের বাইরের কেউ উত্ত্যক্ত করলে তাঁদের কিছু করার থাকে না। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনায় স্কুলে ছাত্রীদের উপস্থিতির হার কমে যেতে পারে। আতঙ্কে অনেকেই মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন।
গতকাল দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো গ্রামে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। লাশ আনার পরপরই শুরু হয় বৃষ্টি। কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় লাশগুলো। বৃষ্টির মধ্যেই স্বজন ও গ্রামবাসী শেষ দেখার জন্য ভিড় জমায় দুই বাড়িতে।
মাটি দিতে আসা কয়েকজন তরুণ চিৎকার করে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, আসামিদের বেশির ভাগই স্থানীয় প্রভাবশালী একটি পরিবারের সন্তান। ওই পরিবারটির সঙ্গে আবার সুমাইয়ার বাবার জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তাঁদের অনেকেই সেই পরিবারটিকে এই হত্যার জন্য দায়ী করেন।
বাদ আসর জানাজা শেষে সুমাইয়াকে বাড়ির উঠানের পাশে আর হ্যাপিকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.