এক চাকায় চলছে দেশ by এম সাখাওয়াত হোসেন

বর্তমান সরকারের দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই বলেই মনে হয়। তাই সরকার, যত বিতর্কই থাকুক, ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আগামী আরও চার বছর, মানে ২০১৯ সাল পর্যন্ত থাকার রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ বছর অথবা আগামী বছরের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় যে সাজাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, একাধিক মন্ত্রীর তেমনটাই আশা। তারেক রহমান তো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছেনই। আগাম নির্বাচন হোক বা না-ই হোক, আগামী নির্বাচনে এ দুজন ছাড়াও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচনের সুযোগ পাবেন বলে মনে হয় না।
বর্তমানে বিএনপি ছাড়া জামায়াতে ইসলামী, যারা গত বছর নির্বাচনের আগে থেকেই তাণ্ডব চালিয়েছিল বলে অভিযুক্ত, সেই দল তো এমনিতেই রাজনৈতিক আইনে প্রায় নির্বাসিত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার ফাঁসির রায় হয়েছে এবং ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে। আর ধরপাকড় তো চলছেই। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নামে এত মামলা যে তার ভারে ন্যুব্জ এসব দলের সদস্যরা। অপর দিকে দেদার চলছে গ্রেপ্তার-বাণিজ্য এবং অর্থের বিনিময়ে সরকারি দলে যোগদান। অভিযোগ রয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর মাঠপর্যায়েরর শত শত কর্মী এখন আওয়ামী লীগে ঠাঁই নিয়েছেন। অপর দিকে পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপির স্থানীয় নেতারা সরকারি দলে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগকে কৃতার্থ করছেন।
দেশে গণতন্ত্রের যে কথা শুনি, অবশ্য এখন খুব বেশি একটা শোনা যায় না, তা ‘টেইলর মেড’ গণতন্ত্র। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে দেশের ভোটাররা, সাধারণ মানুষ, এমনকি খোদ নির্বাচন কমিশনও যে খুব একটা চিন্তা করে বলে মনে হয় না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি নির্বাচনের মাধ্যমেই ঠোকা হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলো কি না হলো, তার পরোয়া নির্বাচন কমিশন করছে বলে মনে হয় না। খবর বের হয়েছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার ইউএনডিপির সমন্বয়ে অর্থায়িত এসইএমবির (স্ট্রেনদেনিং ইলেকটোরাল ম্যানেজমেন্ট বডি) বাকি অর্থ ছাড় দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর কারণ পরিষ্কার করা হয়নি। তবে এমন কিছু হবে, তার আলামত সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রতীয়মান হচ্ছিল। নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারেই গুঁড়িয়ে গেছে এ নির্বাচনের মাধ্যমে।
সিটি করপোরেশনে ব্যাপক অনিয়মের তদন্ত করার বিষয়টি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার বা নির্বাচন কমিশন কেউই এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সর্বশেষ নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। ইইউ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। নির্বাচন কমিশনের আলোচিত প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ জোগান দেয় ব্রিটেনের ডিএফআইডি ও ইইউ। এ সবই ওই সব দেশের জনগণের ট্যাক্সের অর্থ। এ অর্থের সদ্ব্যবহার ও কার্যকারিতার জবাবদিহি করতে হয় ওই সব দেশের সংসদে। ওই সব দেশের সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের কাছেই জবাবদিহি করে থাকে। কাজেই পার্লামেন্ট বা সংসদে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। পত্রপত্রিকা মারফত জানা যায় যে দাতা দেশগুলো অর্থ জোগান দেওয়া বন্ধ করেছে। কাজেই এ বিষয়ে বড় ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না।
...২...
এ কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে গণতন্ত্রের অন্যতম চাকা বিরোধী দল, তা সংসদের বাইরে এবং ভেতরে। যদি বিরোধী দল না থাকে অথবা দুর্বল থাকে, সে ক্ষেত্রে সরকারের জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাব ঘটে। আরও যা ঘটে তা হলো লাগামহীন ক্ষমতার প্রভাবে তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আইনের শাসনে ঘাটতি দেখা যায়। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত না হলে সেই সব সরকারকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়। গবেষকেরা আরও যা বলেন, তা হলো সরকারি দলের মধ্য ভারসাম্যের অভাব ঘটে এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা এমনই এক সময়ের দ্বারপ্রান্তে। সরকার এখন নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় রয়েছে। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তাদের বেশির ভাগ আচরণই কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সংগঠনের মতো নয়। এটি একধরনের নিয়ন্ত্রণহীন সংগঠনে পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে মহাখালী ওয়ারলেস গেটের তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের বেশ কিছু সদস্য রেস্তোরাঁয় ‘ফাউ’ খেতে গিয়ে যে আচরণ করল, তা কোনো নিয়ন্ত্রিত সংগঠনের আচার-আচরণের মধ্যে পড়ে না। নির্দোষ ব্যক্তিদের প্রায় ৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। কোনো সভ্য দেশে এমন হতে পারে না। এর ক্ষতিপূরণ কারা দেবে? এর দায়দায়িত্ব সরকারি দল নেবে কি?
শুধু ছাত্রলীগই কেন? সরকার এখন এক সাবেক ও দুই ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে নিয়ে বেশ বেকায়দায়ই রয়েছে। এঁদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শুধু মন্ত্রিত্বই হারাননি, তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদও প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে সরকারি দল থেকে বলা হয়েছে। তথ্যে প্রকাশ, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কারের পত্র সংসদের স্পিকারের কাছে পাঠিয়েছে। সংসদের স্পিকার পত্র পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা-ই যদি হয়ে থাকে, যদিও এখনো পরিষ্কার নয়, তাহলে সাদামাটা ব্যাখ্যা এবং অতীত দৃষ্টান্তের আলোকে কোনো আইনেই তিনি সংসদ সদস্য থাকতে পারেন না। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০-এর সূক্ষ্ম তর্জমায় যদিও বা এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো কিছু ধেঁায়াশা থাকতে পারে। কিন্তু আরপিওর ধারা ১২(১)(বি) মোতাবেক তিনি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে নমিনেশন নিয়েছিলেন এবং তিনি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি, যা নমিনেশনের সময়ই করার কথা। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন স্পিকার ও নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে এ দুই পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য আসার আগেই সরকারি দলের একজন শীর্ষ নেতা মতামত দিয়ে বললেন, লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি স্বতন্ত্র সদস্য থাকবেন। দল থেকে বহিষ্কারের পর বিএনপির একজন সংসদ সদস্যের পদ অতীতে খারিজ হয়েছিল। এ দৃষ্টান্ত খুব বেশি দূর অতীতের নয়। মেজর (অব.) আখতারের সংসদ সদস্য পদ খারিজের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯৯ সালে সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হলে তৎকালীন স্পিকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠালে কমিশন তার পদ খারিজ করেছিল। আরেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে নিয়ে সরকার বিপাকেই পড়েছে। আইনের সাদা চোখে মায়ার শুধু মন্ত্রিত্বই নয়, সংসদ সদস্যপদও থাকে না, যা সংবিধানের ৬৬ ধারার (২)-এর (ঘ)তে সুস্পষ্টভাবেই উল্লিখিত। ইতিমধ্যে মায়ার মন্ত্রিত্বের এবং সংসদ পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৭ জুলাই ২০১৫ সালে জনস্বার্থে একজন আইনজীবী রিট করেছেন। বিষয়টি যে সরকারের জন্য মোটেও সুখকর নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম নিয়ে যে ধরনের তুঘলকি কারবার হচ্ছে, সে সম্পর্কে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এই গম খাদ্য মন্ত্রণালয় অনেক সংস্থাকে গেলাতে চেষ্টা করেও পারেনি। ধারণা করি, এগুলো এখন রিলিফ ও কাবিখার মাধ্যমে গ্রামের গরিব মানুষের পেটে যাবে। মধ্যবিত্তদের পেটে যাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বদৌলতে পাউরুটি অথবা তন্দুরি চিকেনের সঙ্গে নানরুটি হিসেবে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় আনুমানিক প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন গম যেভাবে বাজারে প্রবেশ করাতে চাইছে, তা যেকোনো উন্নত দেশের সরকার পতনের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমাদের দেশে সে ধরনের কোনো জবাবদিহি নেই। এমনকি নৈতিক দায়িত্ব নিয়েও কোনো মন্ত্রী আজ পর্যন্ত পদত্যাগ করেননি। ভবিষ্যতেও করবেন বলে মনে হয় না।
...৩...
পুলিশের বেশির ভাগ সদস্যের কর্মকাণ্ডে খোদ পুলিশ প্রশাসন বিব্রত। পুলিশের মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তার হাবভাব এখন কিংমেকার পর্যায়ে, অনেকাংশে খোদ পুলিশ প্রশাসনই অসহায়। এতে সরকারে ভাবমূর্তি কতখানি ক্ষতি হচ্ছে, তা ভেবে দেখতে হবে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হারালে তার মূল্য শুধু সরকারকেই নয়, তার চরম মাশুল দিতে হবে জনগণকেও। সমাজে হতাশা আর সংঘাতের সৃষ্টি সরকারের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হবে না। এর অনেক উদাহরণ ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে, যার একটি গাইবান্ধার পুলিশ বনাম আদালত এবং আলোচিত জ্যেষ্ঠ বিচারকের বদলির আদেশ প্রদান। বলা হচ্ছে, এটি কাকতালীয়। কিন্তু এ সময় তা না করলে জনমনে সন্দেহ দেখা দিত না।
...৪...
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দৃশ্যত শান্ত থাকলেও সরকারি দলের মধ্যেই অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে যতটুকু গণতন্ত্র আছে, তা-ও কার্যকর নয়। আইনের শাসন ব্যাহত। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর বেপরোয়া, লাগামহীন, ‘ফাউ খাওয়া’ আর চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তা কেনোভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাসের লক্ষণ নয়। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় কী ধরনের ক্ষতি হতে যাচ্ছে, তা সরকারি দল ভালোভাবে টের পেতে শুরু করেছে বলে আমার বিশ্বাস।
দেশের বর্তমান অকার্যকর রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির জন্য শুধু সরকারি দলই কি দায়ী? বিএনপির মতো বৃহৎ দলের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আর অবিবেচক সিদ্ধান্তও এ পরিস্থিতির জন্য সমানভাবে দায়ী। তারা দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি। হোক না নিম্ন-মধ্যম আয়ের। কিন্তু কবে আমরা একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হতে পারব, সে প্রশ্ন রয়েই গেল।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.