হাসিনা-খালেদার ঈদ দর্শন এবং ওয়াঘা সীমান্ত by সোহরাব হাসান

প্রতিবারের মতো এবারেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ঈদের দিন সকালে আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান ছিল গণভবনে। আর বিএনপি চেয়ারপারসনের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। পথের দূরত্বে এক কিলোমিটার হলেও মনের দূরত্বে সহস্র কিলোমিটার।
এ সব আয়োজনে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাইরে যাঁরা অভিন্ন অতিথি থাকেন তাঁরা হলেন বিদেশি কূটনীতিক। এখানে দায়িত্বরত কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা মোটামুটি জেনে গেছেন। তাই তাঁরা বেশ কৌতূহলের সঙ্গে দুই আয়োজনে যোগ দেন। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মারসা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট ঈদের সকালে যেভাবে শাড়ি পরে দুই নেত্রীর সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন, তাতে মনে হলো তিনি অল্প দিনেই বাঙালি সংস্কৃতি ও আচারের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তবে আমাদের নেতানেত্রীরা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কেননা বাঙালি সংস্কৃতি তো কেবল পোশাক-আশাকে সীমাবদ্ধ নয়, আচার-আচরণে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা বাঙালি সংস্কৃতির অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে মন্ত্রিসভায় অদলবদল নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে ‘ঝড়’ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ‘জনপ্রশাসন’ মন্ত্রণালয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আপাতত সেই ‘ঝড়’ সামাল দিয়েছেন বলে ধারণা করি। শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তাঁর পাশাপাশি সৈয়দ আশরাফের উপস্থিতি সেটাই প্রমাণ করে। মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক ‘রদবদল’( আসলে এটি রদবদল ছিল না, ছিল অদলবদল। কেননা প্রধানমন্ত্রী কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি। এমনকি যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ আছে, তাঁরাও বহাল তবিয়তে আছেন) প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারের কাজে গতি আনতেই তিনি এটি করেছেন। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কি স্বীকার করে নিলেন না যে সরকারের কাজে এত দিন কাঙ্ক্ষিত গতি ছিল না। গতি থাকলে অদলবদলের প্রয়োজন হতো না। মন্ত্রিসভার অদলবদল নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করেছেন, তাদেরও এক হাত নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, মন্ত্রিসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। তবে আমাদের বিশ্বাস, ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখেই তিনি ‘দপ্তরহীন’ সৈয়দ আশরাফকে দপ্তর দিয়েছেন। শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, সরকার প্রধান চাইলে যেকোনো সময় মন্ত্রিসভা অদলবদল করতে পারেন। তাঁর এই যুক্তি অস্বীকার না করেও যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। এই সরকারের প্রতি কতভাগ মানুষের সমর্থন আছে সেই প্রশ্ন তোলাও অস্বাভাবিক নয়।
ঈদের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের ন্যায় পদক্ষেপের কারণেই দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ও আনন্দের সঙ্গে ঈদ করতে পারছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জেনেছেন যে পথের বিড়ম্বনার কারণে অনেকের ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছে। পাঁচ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ১৫ ঘণ্টা লেগেছে। তার পরও বলব, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কম ছিল। সংশ্লিষ্টরা আরেকটু সজাগ হলে জনদুর্ভোগ আরও কমানো যেত। সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ঈদের আগে মহাসড়কে ভয়াবহ যানজট দেখতে গিয়ে বলেছেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে এটি হয়েছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়কে যাতে নামতে না পারে সেটি দেখার দায়িত্ব কার? তিনি হয়তো বলবেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু ফিটনেস ছাড়া গাড়ি যদি রাস্তায় নামতে পারে তাহলে বিআরটিএ কী করছে? ফিটনেসবিহীন লঞ্চ নৌপথে চললে বিআইডব্লিউটিএ রাখারই বা কি দরকার?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, তাঁরা এখন দল পুনগর্ঠনের কাজ করছেন। পুনর্গঠন শেষে তারা ফের ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন করবেন। প্রশাসন, পুলিশ বিচার বিভাগ দলীয়করণের শিকার বলে দাবি করে তিনি বলেছেন, মানুষ এখন অসহায়। প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি গুমখুনের ঘটনা ঘটছে। যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তারা জনগণকে জিম্মি করছে।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে খালেদা জিয়া আগেও দল পুনর্গঠন করে আন্দোলনে নামার কথা বলেছিলেন। এ বছর ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপির লাগাতার অবরোধ-হরতাল করে সরকার পতনের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। তাহলে ৫ জানুয়ারির পর তিনি কেন সেই সিদ্ধান্ত দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিলেন? আর সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ ছিল না তার প্রমাণ বাস-ট্রাকে আগুন ও পেট্রলবোমায় শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু। তাই দলকে পুনর্গঠন করে তিনি যে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন, তা যে শান্তিপূর্ণ থাকবে তার নিশ্চয়তা কি? আগে নিয়ত ঠিক করুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন প্রশ্ন রেখেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন দল থাকলে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হবে না কেন? তাঁর এই প্রশ্নটি সম্ভবত সবার আগে নিজেকে করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপের জন্য তাঁকে টেলিফোন করছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সংলাপে রাজি হননি।
তাই খালেদা জিয়া যখন ভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছেন, তখন আমরা ২০১৩ সালে অক্টোবরের আগে থেকে শুরু করতে পারি। সেটি হতে পারে দুই শর্তে। সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক কোনো মামলা দেবে না; কাউকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করবে না। আবার বিরোধী দলও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করবে না। হরতাল-অবরোধের নামে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করবে না।
অর্থাৎ দুই পক্ষই ‘যুদ্ধের’ নীতি মেনে চলবেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্পর্কটি ওয়াঘা সীমান্তের মতো হবে না; যেখানে একপক্ষের ঈদের মিষ্টি অন্য পক্ষ ফিরিয়ে দেয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.