হাইওয়ে পুলিশ অসহায়!

দেশের বিভিন্ন মহাসড়কের ২০৯টি স্থানকে দুর্ঘটনাপ্রবণ বলে চিহ্নিত করে একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তা নিয়ে তিন বছর আগে সড়ক নির্দেশনা বোর্ড লাগিয়েছিল পুলিশ। এতে এক-চতুর্থাংশ দুর্ঘটনা কমে যায় বলে দাবি করছে পুলিশ। কিন্তু রোদ-বৃষ্টিতে বোর্ডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, এরপর কেউ সেসব আর মেরামত করেনি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো দুর্ঘটনা ঘটলেই সব দায় পুলিশের ওপর চাপানো হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মল্লিক ফকরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেপরোয়া গাড়িচালনা এবং সড়ক নির্দেশনা ও বিভাজন না থাকা দুর্ঘটনার মূল কারণ। এর মধ্যে প্রথম বিষয়টি পুলিশ দেখে। অন্য দুটি বিষয় পুলিশের হাতে নেই। তা ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের লোকবলও কম। তাদের পক্ষে দেশের ২১ হাজার কিলোমিটার হাইওয়ে পাহারা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। তিনি বলেন, অনেক চালক সাংকেতিক চিহ্নও (সাইন) ঠিকমতো বোঝেন না।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গাড়িচালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা হয়। চালকেরা বলছেন, সড়কের ওপর যত্রতত্র গড়ে ওঠা বাজার আর চলাফেরায় অসাবধানতার কারণেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। একজন চালক বলেন, বড় কারণ হলো, পথচারীর অসতর্কতা। দ্বিতীয় কারণ হলো রাস্তাঘাট ও দোকানপাট।
একজন যাত্রী বললেন, সাধারণত দিনে চলাচলকারী বাসগুলোর চালকেরা একটু বেশি বেপরোয়া থাকেন। তবে দূরপাল্লার চেয়ে আঞ্চলিক রুটের চালকেরা দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী। তিনি বলেন, যখন ডে-কোচে যাই তখন ভয় লাগে। গাড়িগুলোর গতি দেখে মনে হয়, কেউই আইন মানেন না।
হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য মোটর আইনের ১৪২ ও ১৪৩ ধারায় জরিমানা মাত্র ৩০০ টাকা। অথচ সিঙ্গাপুরে জরিমানা পাঁচ হাজার ডলার। জরিমানা কম হওয়ার কারণে কোনো চালক ভ্রুক্ষেপ করেন না। বেশি জরিমানার বিধান থাকলে সড়কে নেমেই চালকেরা আগে গাড়ির গতি নিয়ে ভাবতেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জরিমানার অঙ্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে সড়ক বা মহাসড়কের ওপর তৈরি হওয়া বাসস্ট্যান্ডগুলোতেই। দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা ও যানবাহন, ট্রাফিক আইন প্রয়োগে দুর্বলতা এবং চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা।
পুলিশের হিসাবে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে প্রধান প্রধান মহাসড়কে মোট ৮৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮৮৩ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৫২৯ জন। দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৩৯টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, হাইওয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ২০১টি গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে ৯৮৫টি ঘটনার ক্ষেত্রে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগ ছিল।
হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। এসব সুপারিশের মধ্যে চালকদের সচেতন করা, গতিনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানো, যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে লাইসেন্স দেওয়া, চালকের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় সড়কে সিসি ক্যামেরা বসানো, অতিরিক্ত ওজন বহন রোধ করা, নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালক করা, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করা, দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান চিহ্নিত করা, সড়কের দুই পাশ থেকে বাজার উচ্ছেদ করা, ধীর গতির গাড়ি মহাসড়কে চলতে না দেওয়া ছিল অন্যতম সুপারিশ। কিন্তু সব মহল থেকে এসব নিয়ে নানা কথা বলা হলেও সুপারিশ আর বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে উপমহাপরিদর্শক প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, লোকবল কম থাকার কারণে তাঁরা সড়কে ঠিকমতো আইন প্রয়োগ করতে পারছেন না। এ জন্য তিনি হাইওয়ে পুলিশের জনবল আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

No comments

Powered by Blogger.