অপেক্ষা কললিস্টের by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

শুধুমাত্র মোবাইল কললিস্টের অপেক্ষা। এরপরই খোলাসা হবে শিশু রাজন হত্যা ঘটনায় কাদের কি ভূমিকা ছিল। আর এ ঘটনা খোলাসা হলেই নির্ধারিত হবে পুলিশ না রাজনের বাবার এজাহার এফআইআর হিসেবে গণ্য হবে। এদিকে এ হত্যা ঘটনায় পুলিশ ও নিহতের বাবার দুটি এজাহার মিলিয়ে মোট আসামি চারজন হলেও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ জন। পুলিশ এজাহারনামীয় আসামিদের লতায়-পাতায় যত আত্মীয়স্বজন পাচ্ছে তাকেই ধরে আনছে। এ ছাড়াও বিভাগীয় মামলায় যে কোন সময় শাস্তির খড়গ নেমে আসতে পারে এসআই আমিনুল ইসলামের উপর। এমন কি তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ঈদের ছুটি বাতিল করে তাকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। চৌকিদার  ময়না গতকাল সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম (তৃতীয়) আদালতে রাজন হত্যা ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি নির্ধারিত ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে পারেনি। ১৭ই জুলাই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দাখিলের কথা ছিলো। এ বিষয়ে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রুকনউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের তালিকা এখনও হাতে আসেনি তাই রিপোর্ট দাখিলের সময় আরও ৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দেরি হবে না-ফোন ট্র্যাকিংয়ের তালিকা হাতে আসলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই রিপোর্ট দিয়ে দেবো। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টায় কারা জড়িত। এছাড়াও যে দুইটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি করে তৎক্ষণাত কামরুল ও মুহিত ৬ লাখ টাকা জালালাবাদ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে যোগান দিয়েছিলো, সেই অটোরিকশা দুইটির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার (সিলেট-ত-১২-১৮০২ এবং সিলেট-ত-১৩-২৩৩), কারা এর মালিক এবং অটোরিকশা দুটি কোথায় কার কাছে বিক্রি হয়েছে-এসব তথ্য এখন তদন্ত কমিটির হাতে।
এদিকে পুলিশের দায়েরকৃত এজাহারে হত্যা ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা রয়েছে বলে আইন পেশায় নিয়োজিত অনেকেই মন্তব্য করেছেন। মামলার নথি পর্যালোচনা করে তারা বলছেন, রাজন নিহতের ঘটনায় জালালাবাদ থানার এস আই আমিনুল বাদী হয়ে ৮ই জুলাই রাত ৮টা ৪০ মিনিটে মামলা (নং:০৪) করেন। ঐ রাতেই রাজনের বাবা আজিজুর রহমান আলম রাজনের লাশ শনাক্ত করেন। তারপরও পুলিশ রাজনকে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’ পরিচয়ে যে মামলাটি করেছিলো তা সংশোধন করতে পারতো। কারণ পুলিশ আদালতে নথি প্রেরণ করে পরদিন ৯ই জুলাই। এফআইআর সংশোধন না করায় প্রমাণিত হয়েছে  কোন ‘দুরভিসন্ধি’ ছিলো। এ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ই ইউ শহীদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, রাজন হত্যা মামলায় এসআই আমিনুল ইসলাম কর্তৃক দাখিলকৃত এজাহারে আসামি মুহিত আলম ও ময়না মিয়ার নামোল্লেখক্রমে আশপাশ ওয়ার্কশপের লোকজন জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে রাজনের বাবা আজিজুর রহমান আলমের দরখাস্তে মুহিত, আলী, কামরুল, ময়না ও অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জন জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুইজন আসামির নাম উভয় দরখাস্তে থাকলেও মোট আসামি ৪ জন। অথচ পুলিশ ইতিমধ্যে ডজনখানেক লোককে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের এই অতি আগ্রহ জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। পুলিশ এজাহারনামীয় আসামিদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকেও আটক করেছে। এ ধরনের ঢালাও গণগ্রেপ্তার মামলার কার্যক্রমকে ভিন্নখাতে নিয়ে যেতে পারে। আইনজীবী ই ইউ শহীদুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি আইনে অপরাধের দায় ‘ইনডিভিজ্যুয়াল লায়েবিলিটি’। একজনের কৃত অপরাধের দায় অন্য কারো উপর বর্তানো ফৌজদারি আইন কোনভাবেই সমর্থন করে না। তিনি বলেন, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে পুলিশকে  পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে। সজাগ থাকতে হবে যাতে কোনভাবেই পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ না উঠে।
সামিউল আলম রাজন হত্যা ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব এখন নগর গোয়েন্দা পুলিশের। জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মো. আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠায় তাকে বুধবার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার। তদন্ত কর্মকর্তা সোমবার বিকালে মানবজমিনকে বলেন, কাজ করে যাচ্ছি। ভীষণ ব্যস্ততা। ৭ জন আসামিকে হেফাজতে এনেছি- তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তদন্ত কর্মকর্তা সুরঞ্জিত তালুকদার বলেন, ময়নার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। বলাৎকারের বিষয়ে ময়নার কোন বক্তব্য পাওয়া গেছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে সরাসরি এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব নয়। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আখতার হোসেন মানবজমিনকে জানান, তদন্তের দায়িত্ব এখন তাদের হাতে না থাকলেও আসামি গ্রেপ্তারে তারা গোয়েন্দা পুলিশকে সহযোগিতা করছেন। তিনি আরও জানান, এ হত্যা ঘটনার কোন আসামি এখন আর তাদের হেফাজতে নেই। গোয়েন্দা পুলিশ কোতোয়ালি থানাসহ বিভিন্ন স্থানে রেখে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
রাজন হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঈদের দিন টুকের বাজারের হায়দারপুর  থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন আলী হায়দারের শ্যালক রুহুল আমীন। এর আগে শুক্রবার শেখপাড়া থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন কামরুল-মুহিতের বড় ভাই আলী হায়দার। এদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় মুহিত আলম, চৌকিদার ময়না, দুলাল আহমদ এবং সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হাতে আটক কামরুল ইসলাম। এছাড়া, ফিরোজ আলী ও আজমত আলী ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী আটক আছেন। এ দু’জন ইতিমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন। এছাড়াও গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজনের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলে ধারণকারী নূর আহমদ এবং প্রধান আসামি মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগম। এদিকে ৫ দিন পুলিশ রিমান্ডে থাকা মুহিত আলমের রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই আরও ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাকে। মুহিতের তালতো ভাই ইসমাইল হোসেন আবলুসের দ্বিতীয় দফা ৭ দিনের রিমান্ড চলছে। এছাড়াও ৭ দিনের রিমান্ডে আছেন নূর আহমদ, দুলাল, আলী হায়দার ও রুহুল আমিন। এ হত্যা ঘটনায় গ্রেপ্তার নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন আরেক দফা বাণিজ্যের পথ খুলেছে পুলিশ। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আলী হায়দারের শ্যালক রুহুল আমীন, মুহিতের তালতো ভাই ইসমাইল হোসেন আবলুস এবং ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী ফিরোজ আলী ও আজমত আলী রাজন হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভাবেই সম্পৃক্ত নন। এদের কেউ হত্যা ঘটনা দেখেছেন কিন্তু পুলিশকে জানাননি বা আসামিদের আত্মীয় বলেই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা বলছেন, নির্যাতন ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও কামরুল-মুহিতের ভয়ে কেউই প্রতিবাদী হতে সাহস করেননি। আবার এত সকালে কারো সঙ্গে ছিলো না মোবাইল-জানেন না থানার নাম্বারও। এ প্রসঙ্গে তারা তথ্য দেন, কামরুল-মুহিতের বাবা আব্দুল মানিকের বসতভিটা ছিলো টুকের বাজার ইউনিয়নের হায়দরপুর গ্রামে। তার ছেলে আলী-কামরুল-মুহিতের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে মানুষ। ২০০০ সালে তারই এক মামাতো ভাইকে ব্যাপক নির্যাতন করলে এলাকাবাসী তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আশ্রয়হীন মানিকের পরিবার চলে আসে শ্বশুরবাড়ি পার্শ্ববর্তী গ্রাম শেখপাড়ায়। আশ্রয় দিতে না চাইলে আলী-কামরুল-মুহিত মায়ের ফরায়েজ দাবি করে সেখানেই জোর করে ঘর বানিয়ে ফেলে। সেই থেকে তাদের ঠিকানা হয় শেখপাড়ায়। আলী হায়দার চলাফেরা করতে থাকে ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে আলীও থানা পুলিশের সঙ্গে সমঝোতায় অংশ নিতো। এভাবেই পুলিশের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে আলী হায়দারের। আলী হায়দার এখন টুকের বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা। তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদী হয়নি বা পুলিশকে জানানোর সাহস করেনি। ঘটনা প্রকাশের পর এসব মানুষইতো আসামিদের ধরিয়ে দিচ্ছে।
শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্মম নির্যাতনে হত্যার পর এলাকাবাসী কামরুল ইসলাম ও মুহিতুল আলমকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছিলো। অভিযোগ ওঠে জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মো. আলমগীর হোসেন ও এস আই আমিনুল ইসলাম ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে হত্যা ঘটনা ধামাচাপা দিতে উদ্যোগী হন। ৬ লাখ টাকা হাতে পেয়ে কামরুলকে সৌদি আরব পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। দুইটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি করে তৎক্ষণাত কামরুল ও মুহিত ৬ লাখ টাকা জালালাবাদ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে যোগান দিয়েছিলো। কথা ছিলো আরও ৬ লাখ টাকা পেলে মুহিতকেও ছেড়ে দেয়ার। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
৮ই জুলাই সিলেট নগরীর কুমারগাঁওয়ে গাড়িচালক শেখ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান আলমের ছেলে সামিউল আলম রাজনকে কুমারগাঁও এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে ভ্যান চুরির মিথ্যা অপবাদে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এ চিত্র মোবাইলে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। একপর্যায়ে রাজন মারা গেলে তার লাশ একটি মাইক্রোবাসে তুলে গুম করার চেষ্টাকালে জনতা শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালিকের ছেলে কামরুল ইসলাম ও মুহিত আলমকে আটক করে জালালাবাদ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে ঐ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ সহায়তায় কামরুল সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হাতে আটক হয়। সামিউল আলম রাজন সিলেট নগরীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের পাশে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদে আলী গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করা রাজন সবজি বিক্রি করতো।

No comments

Powered by Blogger.