কামরুলকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ

পৈশাচিক নির্যাতনে সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আরও দুই আসামি নূর মিয়া ও দুলাল আহমদ। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পৃথকভাবে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিলেট মহানগর আদালত-২-এর ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ারুল হক। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় একই আদালতে জবানবন্দি দেন ময়না মিয়া। এ নিয়ে এ মামলায় দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৫ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। এদিকে সৌদি আরবে গ্রেফতার রাজন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলামকে দেশে ফেরত আনার জন্য ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সংস্থাটির রেড নোটিশে কামরুলের ছবি দিয়ে তার সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
রাজন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদার যুগান্তরকে জানান, আসামি নূর মিয়া ও দুলাল আহমদ অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তারা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। এদিকে রিমান্ডে নেয়ার পর অপর আসামি আলী হায়দার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, জবাবন্দিতে নূর জানান, ঘটনাস্থলের পাশেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নূর আহমদ সিএনজি ওয়ার্কশপ। ঘটনার আগের দিন সারা রাত কাজ শেষে ওয়ার্কশপেই ঘুমাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পুকুরপাড়ে যাওয়ার সময় দেখি কামরুল, চৌকিদার ময়না ও অজ্ঞাত লম্বা একটি ছেলে রাজনকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করছে। তখন কামরুল আমাকে বলে, ভাইগ্না চোর ধরছি। তুই ভিডিও কর, তারপর ইন্টারনেটে ছেড়ে দে। মানুষ যেন দেখে চোরকে কীভাবে পেটানো হয়। কামরুলের কথামতো আমার মোবাইলে প্রায় ২৮ মিনিট ভিডিও রেকর্ড করি। দুপুরের দিকে খবর পাই শিশু রাজন মারা গেছে। পরে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গেছে ভেবে মোবাইলের ভিডিওটি লোকজনকে দেখাই। এ সময় অনেকেই ভিডিওটি মোবাইলে নেয় ব্লু-টুথে করে। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক ভিডিওটি নিয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দেন। খুব সম্ভবত ওই সাংবাদিকের নাম পংকি।
এদিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুলাল জানান, তিনি একজন চা বিক্রেতা। ঘটনাস্থলের পাশে একটি টংঘরে তিনি চা বিক্রি করেন। ঘটনার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘটনাস্থলে এসে দেখতে পান চৌকিদার ময়না একটি গ্যারেজের পাশে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে এক শিশুকে মারছে। এ সময় ময়নার হাতে থাকা লাঠি নিয়ে কামরুল শিশুটিকে পেটাতে শুরু করে। তারা আমাকে বলে, ভ্যান চুরির সময় তাকে হাতেনাতে ধরেছে। তবে রাজনের স্বজনদের দাবি, সব স্বীকারোক্তির ভাষ্য অনেকটা এক। আসামিরা রাজনের বিরুদ্ধে ‘চুরির’ অপবাদ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। এসব জবানবন্দির মাধ্যমে ‘বিতর্কিত এজাহার’ প্রতিষ্ঠার যড়যন্ত্র হচ্ছে। রাজনের খালু আবদুল খালেক বলেন, ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগে ক্লোজড আমিনুল এ এজাহারের ‘রচয়িতা’। তিনি এজাহারে শিশু রাজনকে লিখেছে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’। ভিকটিমকে বলা হয়েছে ‘চোর’। অপবাদ দেয়া হয়েছে চুরির। স্বজনদের দাবি, রাজন চোর নয়, সত্য গোপন করা হচ্ছে। এত কিছুর পর মামলার এজাহারকারী এসআই আমিনুলকে ক্লোজড করা হলেও মামলা গ্রহণ ও তদন্তকারী জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর এখনও বহাল তবিয়তে।
৮ জুলাই বুধবার শহরতলির কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শিশু রাজনকে পিটিয়ে খুন করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি কামরুল সৌদি আরবে আটক হয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া আরও ১০ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে রাজনের লাশ গুমের চেষ্টাকালে স্থানীয়রা মুহিত আলমকে আটক করে পুলিশে দেন। এরপর ১৩ জুলাই মুহিতের আত্মীয় ইসমাঈল হোসেন আবলুসকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ১৪ জুলাই চৌকিদার ময়নাকে পুলিশে দেন স্থানীয়রা। এরপর ১৫ জুলাই দুলাল আহমদ ও নূর মিয়া, ১৮ জুলাই রুহুল আমিনকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। প্রত্যক্ষদর্শী ফিরোজ ও আছমত আলী, মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগমকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরমধ্যে সোমবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ময়না চৌকিদার। এর আগে ১৪ জুলাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফিরোজ আলী ও আসমত উল্লাহ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ঘটনা দেখার পরও পুলিশকে না জানানোর কারণে এ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া মুহিত আলম, ইসমাইল হোসেন আবলুস, আলী হায়দার ও রুহুল আমিন রিমান্ডে রয়েছেন। আর জেলহাজতে রয়েছেন মুহিত আলমের স্ত্রী লিপি বেগম।
এদিকে এ মামলায় পুলিশের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৬ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি। যদিও তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রুকন উদ্দিন বলেন, প্রতিবেদন দাখিলে একটু বিলম্ব হবে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশ :  রাজন  হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব থেকে ফেরত আনার জন্য ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি করা হয়েছে। তার বিষয়ে যাবতীয় তথ্য আরবিতে অনুবাদ করে দু-একদিনের মধ্যে রিয়াদে ইন্টারপোল শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোতে (এনসিবি) পাঠানো হবে। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় কামরুলের জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৫ এপ্রিল ১৯৬৮। বয়স ৪৮ বছর। জন্মস্থান শেখপাড়া, জালালাবাদ সিলেট। উচ্চতা ৫.৫৯ মিটার। ভাষা বাংলা, আরবি। চুল ও চোখের রং কালো। অভিযোগ- হত্যা, হত্যার তথ্য গোপন। সেখানে তার একটি ছবিও আপলোড করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (এনসিবি) মাহবুবুর রহমান জানান, রেড নোটিশের পর কামরুলের অবস্থান নিশ্চিত করে সৌদি আরবে বার্তা পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে রিয়াদ এবং ঢাকার মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। পুলিশ সদর দফতরের এএনসিবি শাখার এ কর্মকর্তা আরও বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে এখন যাবতীয় তথ্য আরবিতে অনুবাদের কাজ চলছে। শেষ হলে দু-একদিনের মধ্যে তা রিয়াদের এনসিবিতে পাঠানো হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটা রিয়াদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.