কারাগারে হবিগঞ্জ পৌর মেয়রের ওপর হামলা

হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছের
ওপর কারাগারে হামলা চালিয়েছেন অন্য
একজন আসামি। উন্নত চিকিৎসার জন্য
তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
পাঠানো হয়েছে। ছবি: হাফিজুর রহমান
হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হবিগঞ্জ পৌরসভার সাময়িক বরখাস্তকৃত মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এতে তিনি আহত হন। শনিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। তাকে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় রোববার আধাবেলা হরতাল পালন করেছে জেলা বিএনপি। জেলা কারাগার ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সকাল ৯টার দিকে মেয়র গউছ কারাগারের ভেতরে ঈদ নামাজ শেষে তার ডিভিশনের কাছ দিয়ে হাঁটাচলা করছিলেন। এ সময় কারাগারে আটক দুটি হত্যা মামলার আসামি জেলার শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার বিরামচর গ্রামের ইলিয়াছ মিয়া ওরফে ছোটন অতর্কিত বালতির রড দিয়ে জি কে গউছের ওপর হামলা চালায়। এলোপাতাড়ি মারপিটের একপর্যায়ে জিকে গউছ রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় কারারক্ষীরা তাকে উদ্ধার করে জেল সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীরা কারাফটকে এসে জড়ো হন। এ সময় জেল সুপারের অফিস কক্ষে ভাঙচুর চালান উত্তেজিত নেতাকর্মীরা। পরে বিএনপি নেতাকর্মীরা রোববার হবিগঞ্জে হরতাল ঘোষণা দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। বেলা আড়াইটায় মেয়র জি কে গউছকে ঢাকা পাঠানো হয়।
শায়েস্তাগঞ্জে আতঙ্কের নাম ছিল ইলিয়াছ
শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার দাউদনগর গ্রামের কনা মিয়ার ছেলে ইলিয়াছ মিয়া ওরফে ছোটন। সে ছিল শায়েস্তাগঞ্জের আতঙ্ক। তার নাম শুনলেই লোকজনের মাঝে ভয় দেখা দিত। ২০০৮ সালের আগেই সে শায়েস্তাগঞ্জে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করে। মূলত ২০০০ সাল থেকে সে শায়েস্তাগঞ্জ দাউদনগর এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করে। ধীরে ধীরে সে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এরপর তার ভয়াবহতা শায়েস্তাগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। কালো টাকা রোজগারে সে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এলাকায় তার ভয়ে লোকজন আতঙ্কে বসবাস করতো। সে কাউকেই পাত্তা দিত না। ২০০৮ সালের ১৩ই এপ্রিল সে দক্ষিণ লেঞ্জাপাড়ার বাসিন্দা মরম আলীর ছেলে আলী আহমদ সুজনকে হত্যা করে পলাতক ছিল। ঘটনার পর তার পিতা তাকে ত্যাজ্য করেন। এরপর সে ভারতে চলে যায়। সেখানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়ে। মাঝেমাঝে চুনারুঘাটের আসামপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিজের অভিযান শেষে পুনরায় ভারতে চলে যেত। ২০১১ সালের ১৬ই জুলাই সে একই রুটে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। পরে চুনারুঘাট থেকে বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী বাজারে যাওয়ার জন্য সে আবদুল জলিলের সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা ১ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। সন্ধ্যায় বাহুবল বাজারে পৌঁছে জলিল আর যাবে না বলে তার ভাড়া দাবি করে। এ সময় ছোটন ৪শ’ টাকা দিয়ে বাকি টাকা পুটিজুরী বাজারে গিয়ে দেবে বলে চালক জলিলকে বলে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রথমে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে ছোটন নিজেকে উল্লিখিত হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামি বলে পরিচয় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অটোরিকশা চালক জলিল মোবাইলে ফোনে কথা বলে অজ্ঞাত ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু ছোটন মনে করে জলিল ফোনটি পুলিশকে করেছে। আর কিছু না ভেবে সে জলিলকে ছুরিকাঘাত করতে থাকলে সে দৌড়ে গিয়ে একটি বাসায় ঢুকে। এরপর আর কিছু সে বলতে পারে না। ঘটনার পর ছোটন প্রথমে ঢাকা গিয়ে চাকরি খুঁজতে থাকে। পরে চাকরি না পেয়ে সিলেট ও পরে বানিয়াচং উপজেলার মার্কুলী যায়। সেখান থেকে তাকে আটক করা হয়। দুটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে থাকা ছোটনকে জেলেও সবাই সমীহ করে চলে।
বিএনপির হরতাল ও আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভা
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছের ওপর কারাগারে হামলার প্রতিবাদে রোববার অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছে জেলা বিএনপি। শহরের শায়েস্তানগরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং করেন নেতাকর্মীরা। দুপুরে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে সাইফুর রহমান টাউন হলের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট সামছু মিয়া, মিজানুর রহমান, মাহবুবুর রহমান আওয়াল, আজিজুর রহমান কাজল ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী ফরিদ প্রমুখ। এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরকে হত্যার জন্য জি কে গউছ ষড়যন্ত্র করেছেন বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ ও পৌর যুবলীগ। রোববার বিকালে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নিলাদ্রী শেখর পুরকায়স্থর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোতাচ্ছিরুল ইসলামের পরিচালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি। বক্তব্য  দেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলমগীর চৌধুরী, শরীফ উল্লাহ, শেখ সামছুল হক, অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান, মর্তুজা হাসান, মশিউর রহমান শামীম, মরতুজ আলী, আকবর হোসেন জিতু ও অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পৌর যুবলীগও অনুরূপ কর্মসূিচ পালন করে। গতকাল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ। একই কর্মসূচি পালন করে লাখাই উপজেলা আওয়ামী লীগ।
তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা দায়ের
হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের ভেতরে হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। শনিবার রাতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সুবেদার তাজ উদ্দিনসহ একজন হাবিলদার ও দুজন  কারারক্ষীকে আসামি করে এ মামলা করা হয়। এছাড়াও জি কে গউছের ওপর হামলাকারী ইলিয়াছ মিয়া ওরফে ছোটনকে আসামি করে একই দিন রাতে হবিগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছেন জেলার শামীম ইকবাল। এদিকে কারাগারের এ ঘটনার জন্য শনিবার রাতে হবিগঞ্জের এডিএম শফিউল আলমকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করেছেন জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন এনএসআইর উপপরিচালক শাহ আলম, হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাশ, সহকারী পুলিশ সুপার সাজ্জাদ ইবনে রায়হান ও জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন। তদন্ত কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে মতামত ও সুপারিশসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.