খালেদা জিয়ার ভুল by সোহরাব হাসান

যাঁরা মনে করেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনীতি শতভাগ বিশুদ্ধ, তাঁদের সঙ্গে যেমন একমত হওয়া যাচ্ছে না, তেমনি যাঁরা তাঁর রাজনীতিটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান, তাঁদের সঙ্গেও সহমত প্রকাশের সুযোগ কম। রাজনীতি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মতো নয় যে পরীক্ষার খাতায় টিক বা ক্রস মার্ক দিলেই সহজ উত্তর মিলবে। রাজনীতি হলো রাষ্ট্র পরিচালনার একটি দর্শন। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অতীত নিয়ে এত বেশি আচ্ছন্ন যে বর্তমানে জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে আমলেই নিতে চায় না। তারা উভয়ই দুই প্রয়াত নেতার নামে রাজনীতি করেন এবং তাদের প্রবর্তিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মধ্যে দেশবাসীর সব সমস্যার সমাধান খোঁজেন। যেন এর বাইরে কিছু নেই।
সত্য যে শেখ হাসিনার মতো খালেদা জিয়াও রাজনীতিতে এসেছেন একটি বেদনাদায়ক ঘটনার প্রেক্ষাপটে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে নিহত হলে দলটি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। শুরু হয় দলাদলি। জিয়া মারা যাওয়ার পর বয়োবৃদ্ধ বিচারপতি আবদুস সাত্তার, যিনি ছিলেন জিয়াউর রহমানের উপরাষ্ট্রপতি, তাঁকেই দলের ও দেশের দায়িত্ব দিতে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অতি আগ্রহের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। জিয়া হত্যার পর ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের নায়ক জেনারেল মঞ্জুর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও কার নির্দেশে তাঁকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে হত্যা করা হয়, তা আজও অনুদ্ঘাটিত। কয়েক মাসের মাথায় এরশাদ বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৮৪ সালে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন এবং দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজের আপসহীন অবস্থান তুলে ধরেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনী ফাঁদে আওয়ামী লীগ পা দিলেও বিএনপি দেয়নি এবং যার ফল তারা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তুলে নিতে সক্ষম হয়। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৯১-৯৬ সালের মেয়াদে অনভিজ্ঞ খালেদা জিয়া অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। দলের গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়ে তিনি সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করেন। তাঁর প্রথম সরকারের প্রথম দুই-আড়াই বছর জাতীয় সংসদও মোটামুটি প্রাণবন্ত ও কার্যকর ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এসেই খালেদা জিয়া একের পর এক রাজনৈতিক ভুল করতে থাকেন; ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ের পরপরই বিএনপির দলীয় মাস্তানেরা বিরোধী দল ও সংখ্যালঘুদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের আমলে সন্ত্রাস বা মাস্তানি ছিল এলাকাভিত্তিক, আর বিএনপি আমলে সারা দেশে তার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। পরবর্তী সময়ে কয়েকজন বিরোধী দলের নেতাকে হত্যা, দেশজুড়ে জঙ্গিবাদীদের তাণ্ডব, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটলেও সরকার এসবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পরিবর্তে সব দায় বিরোধীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। সে সময় হাওয়া ভবনকে ঘিরে এমন একটি চক্র গড়ে ওঠে যারা নিজেদের সরকারের চেয়েও শক্তিশালী মনে করত। এসবই ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভুল। কিন্তু তিনি বা তাঁর দল এ পর্যন্ত সেই ভুল স্বীকার করেনি। তাঁরা ভেবেছেন কেবল আওয়ামী লীগের ও ভারতের বিরোধিতা করে সত্তর ও আশির দশকের মতোই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে। বিএনপির যে নেতারা এখন ‘আমরা কখনো ভারতবিরোধী ছিলাম না’ বলে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাঁরাই একসময় পার্বত্য চুক্তির ফলে দেশের এক-দশমাংশ ভারত হয়ে যাবে কিংবা গঙ্গার পানি চুক্তির পর ভারত থেকে ময়লা পানি আসবে বলে নসিহত করেছিলেন। সময় বদলেছে। কিন্তু বিএনপি নেতা–নেত্রীরা সেই বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। রাজনীতি করতে হলে অন্য দলের বিরোধিতা করতে হবে কেন? নিজ দলের কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরলে কিংবা তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে নামলে দলের জনপ্রিয়তা আপনাতেই বাড়বে।
সাধারণত ক্ষমতার বাইরে থাকলে দল সংগঠিত হয়, নেতা–কর্মীদের মধ্যে সমঝোতা ও সমন্বয় বাড়ে। কিন্তু বিএনপির নেতারা গত আট বছরেও দল গোছাতে পারেনি। একবার সম্মেলন করলেও একজন স্থায়ী মহাসচিব নির্বাচন করতে পারেনি। এখন বিএনপির ভেতর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, আসলে দলটি কে চালাচ্ছেন, কীভাবে চালাচ্ছেন? দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জানেন না কোথা থেকে কর্মসূচি আসছে। খালেদা জিয়া যখন গুলশানের কার্যালয়ে তিন মাস অবরুদ্ধ ছিলেন, তখন জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারলেও সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। যে আন্দোলনের জন্য বিএনপি সর্বমহলে সমালোচিত, সেই তিন মাসের লাগাতার অবরোধ, হরতাল কিংবা হঠাৎ করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দলের স্থায়ী কমিটির কোনো ভূমিকা ছিল না। কখনো খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, কখনো লন্ডন থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে বলে দলের অনেকে মনে করেন। যেখানে লন্ডন থেকে তারেক রহমান জেলা–উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন, ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে তাঁদের নির্দেশ দেন, সেখানে জ্যেষ্ঠ নেতাদের গুরুত্ব কোথায়?।
গতকাল প্রথম আলোতে বিএনপিকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যার শিরোনাম ছিল, ‘এই বিএনপিকে দিয়ে হবে না’। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ টেলিফোনে এক কর্মীকে বলেছেন, ‘শোনো বলি, এই বিএনপি দিয়ে হবে না। এটুকু জেনে রাখো।... জিয়াউর রহমানের বিএনপি যদি করতে পারো...।’ আসলে এটি মওদুদের একার কথা নয়, দলের অধিকাংশ নেতাই এরকমটি ভাবেন। কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে পারেন না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়: দলের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থায়ী কমিটির কোনো ভূমিকা থাকে না। চেয়ারপারসন নিজে অথবা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই শীর্ষ নেত্রীই দলের ভেতরে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও শেখ হাসিনা দলকে ভাঙতে দেননি, যাঁরা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তিনি তাঁদের মন্ত্রিত্ব না দিলেও জাতীয় সংসদের টিকিটটি দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর দলের চ্যালেঞ্জকারীদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেননি। মান্নান ভূঁইয়ার মতো নেতা বিএনপি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকতে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার ঘটনাও সবার জানা। এর পেছনে কোনো রাজনীতি ছিল না, ছিল ‘যুবরাজের’ মর্জি। অনেকেই মনে করেন, খালেদা জিয়ার পুত্রস্নেহের কাছে দলের নীতি–আদর্শ পরাজিত হয়েছে। সম্ভবত সেই স্নেহের দায় এখনো তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
শেখ হাসিনা যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনী ফল মেনে নিতে পারেননি, তেমনি খালেদা জিয়াও ২০০৮ সালের নির্বাচনকে ফখরুদ্দীন–মইনউদ্দিনের চক্রান্ত বলে প্রচার করে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। সত্য স্বীকার না করলে ভুল সংশোধন হবে কীভাবে?
খালেদা জিয়ার অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েই দলের ভেতরে নানা প্রশ্ন থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে তিনি যে ২০–দলীয় জোট করেছেন, তার মধ্যে যেমন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী আছে, তেমনি আছে চরম মৌলবাদী হেফাজতে ইসলামের অনুসারী চারটি ধর্মীয় দল। আছে সাত খুনের দণ্ডিত আসামির দলও। এসব দলের সংযোজনে বিএনপি লাভবান হয়নি; বরং তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। ভুল হলেও মানুষ বিএনপিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী (প্রকারান্তরে বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ) রাজনীতির ধারক হিসেবেই দেখতে চায়, ধর্মের ঝান্ডাধারী দল হিসেবে নয়।
বিএনপির নেত্রীর সবচেয়ে বড় ভুল যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিতে না পারা। এমনকি কখনো কখনো তাঁর বক্তৃতা–বিবৃতি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে গিয়েছে, যা আওয়ামী লীগবিরোধী অথচ বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষও মানতে পারেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, দল হিসেবে বিএনপি এই মুহূর্তে যে সংকটে পড়েছে, ১৯৮২ সালের পর কখনোই তাকে সে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। ডান পন্থার দিকে প্রবল ঝেঁাক সত্ত্বেও মধ্যপন্থী হিসেবে এত দিন বিএনপির যে অবস্থান ছিল, তা এখন আর নেই। আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা মধ্যপন্থী ও গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা না করে বিএনপির নেতৃত্ব উগ্রবাদী জামায়াতে ইসলামী ও গোঁড়াপন্থী হেফাজতে ইসলামের ওপর ভরসা রেখে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য নয়, দুই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাঁধে ভর করে বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলন ছিল মারাত্মক ভুল।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.