সাগরে ভাসা মানুষের দুঃখের গাথা by মনজুরুল হক

হ্যাঁ, সেসব নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের কথা আমি বলছি, কেউ যাদের নিতে চায় না। বানভাসি মানুষ, সাগরভাসি মানুষ, অভুক্ত মানুষ, মৃত্যুতেও যাদের মেলে না কবর, বরং ছুড়ে ফেলা হয় অথই সাগরে সমুদ্র-প্রাণীর খাবার হিসেবে। মানবতার এই অবমাননা একবিংশ শতাব্দীর চমক জাগানো অগ্রগতির মধ্যেও আমাদের দেখে যেতে হয় এবং আমরা বুঁদ হয়ে থাকি ইন্টারনেট, ফেসবুক আর সেলফি কালচারে। আর মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে আমারই পাশের গ্রাম কিংবা পাড়ার কোনো এক অসহায় তরুণ, জীবনযুদ্ধে পরাজিত না হওয়ার প্রচণ্ড বাসনা যাকে অজান্তেই আটকে ফেলেছিল দালাল-ফড়িয়ার খপ্পরে।
অসহায় এসব মানুষের কথা বলতে গেলে তাই অজান্তেই আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কিছু অমানুষের কথাও এসে যায়, লোভ আর মোহ যাদের নিয়ে গেছে এমন এক অন্ধকার কুঠুরিতে, যাবতীয় মানবিক গুণ যেখানে তারা বন্ধক রেখেছে নগদপ্রাপ্তির কাছে। আর এ দুই দলের মাঝে আছে আরও একশ্রেণির মানুষ, বাহ্যিক পরিচয়ে যাদের অবস্থান আমাদের মতো নগণ্য শ্বাসজীবীদের অনেক ওপরে, তবে কাছে থেকে চোখ বুলিয়ে নিলে দেখা যাবে যার সবটাই হচ্ছে খোলস। আর সেই অমানুষ আর অর্ধেক মানুষদের অন্যের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মত্ত হওয়ার মুখে নিজেদের মানব পরিচয় থেকে বঞ্চিত হয়ে অথই সমুদ্রে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হচ্ছে প্রতারিত কিছু মানুষকে। সে রকম এক ট্র্যাজিক নাটকের আমরা হলাম অসহায় কিছু দর্শক।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি আমার যে খুব অনুরাগ আছে, তা নয়। এর পেছনে প্রত্যক্ষ যে কারণ, তার মূলে আছে তিক্ত এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। বেশ কয়েক বছর আগে টোকিওতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরা একটি সংবাদ সম্মেলনে সঞ্চালকের দায়িত্ব আমি পালন করেছিলাম। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে এসেছিলেন তরুণ কয়েকজন রোহিঙ্গা, জাপানে শরণার্থী মর্যাদা লাভের আবেদন যাঁরা করেছিলেন এবং তাঁদের সেই আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার অপেক্ষায় তাঁরা ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের শেষে এঁদের নেতার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বসবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে কি না। তরুণ সেই রোহিঙ্গা নেতার তাৎক্ষণিক জবাব ছিল ইতিবাচক এবং আমাকে তিনি বলেছিলেন যে বছর পাঁচেক সেখানে তিনি কাটিয়েছেন। সেই সূত্রে তাঁর কাছে আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম, বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ তাঁর আদৌ হয়েছিল কি না। এবারের উত্তর কেবল নেতিবাচকই ছিল না, বরং আমাকে তিনি আরও বলেছিলেন যে বাংলা ভাষা তিনি শেখেননি, তবে শরণার্থী শিবিরের মুসলমান ভাইদের সহায়তায় আরবি আর উর্দু ভাষা তিনি সেখানে রপ্ত করার সুযোগ পান।
দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যে বেশ বড় রকমের ছক-কষা খেলা অনেক দিন থেকে চলছে, তাতে মনে হয় অনেকেই একমত হবেন। তবে এর অর্থ এটা নয় যে ন্যায্য অধিকার থেকে রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করার জঘন্য যে খেলায় মিয়ানমারের প্রশাসন আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ মত্ত রয়েছে, তার প্রতিবাদ আমরা করব না এবং ‘তোমার ঝামেলা আমার নয়’ বলে চোখ বন্ধ করে থাকব।
রোহিঙ্গাদের দাবার ঘুঁটি হয়ে ওঠায় লাভবান হচ্ছে নিশ্চয় একশ্রেণির মানুষ এবং এদের চিহ্নিত করা এখন মনে হয় বাংলাদেশের স্বার্থেই অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। নগদ অর্থের লেনদেন যেখানে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, মধুলোভী মৌমাছির ভিড় সেখানে স্বাভাবিক। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন তাদের দেখিয়ে এদের কাছ থেকে সহজেই জীবনের শেষ সম্বল হাতিয়ে নেওয়ার এক প্রাণঘাতী খেলায় যারা নিয়োজিত, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত প্রভাবশালী মানুষজনও জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবরে সেই সত্যতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রায় রোহিঙ্গাদের এরা তুলে দিচ্ছে।
আর অসহায় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় সম্ভব না হলে স্বপ্নচারী বাংলাদেশি তরুণেরা তো আছেই, বিদেশে ‘উন্নত জীবনের স্বপ্নে’ এরা এতটাই প্রভাবিত যে জমি বিক্রি কিংবা ধারের অর্থে হলেও ডিঙি নৌকায় উপকূল পার হয়ে অদূরে অপেক্ষমাণ মাছ ধরার ট্রলারে উঠে যাওয়ার আগে অনিশ্চিত জীবনের চিন্তা এদের মাথায় একবারের জন্যও খেলে যায় না। অন্যদিকে ৮০০ রোহিঙ্গার ভিড়ে শ খানেক বাংলাদেশি স্বপ্নচারী তরুণ ট্রলারে জায়গা করে নেওয়ায় মিয়ানমার সরকারের পক্ষে এ রকম আন্তর্জাতিক প্রচারে লিপ্ত হওয়া সহজ হয়ে উঠছে যে সমুদ্রে ভাসমান অসহায় সেসব মানুষ দেশত্যাগী শরণার্থী মোটেও নয়, বরং তারা হচ্ছে অর্থনৈতিক অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি। আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি অনেকটাই ভূলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। এর বাইরে ভিন্ন একটি দিক থেকেও আমাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের সরকার জোর গলায় বলে আসছে যে মধ্য আয়ের দেশ হয়ে ওঠা আমাদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার। কিছুদিন আগে দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। সে রকম একটি দেশ থেকে এত বেশি তরুণের উন্নত জীবনের সন্ধানে যেকোনো উপায়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার তো কথা নয়। তবে এরপরও তা হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে, সেদিকে মনে হয় সরকার আর নীতিনির্ধারকদের নজর দেওয়া দরকার। মাথাপিছু আয় একটি দেশের সার্বিক অবস্থার ঝাপসা কিছু ছবিই কেবল আমাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম। ঝাপসা সেই ছবি স্পষ্ট করে তুলতে হলে মাথাপিছু আয়ের বণ্টনের দিকেও নজর দিতে হবে। প্রাপ্তির সবটাই যদি শহুরে বিত্তবান শ্রেণির হাতে যায়, তাহলে মাথাপিছু আয়ের স্ফীতি কোনো কাজে আসবে না এবং দুর্গম পল্লি অঞ্চল আর শহরের ভাসমান দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্মের সামনে অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না।
এই দরিদ্র মানুষগুলোর প্রতারিত হয়ে বিদেশ যাওয়ার পেছনে যে আর্থসামাজিক সমস্যা আছে, সেগুলো দূর করতে জনমত গড়ে তোলা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আর তাই দাতাদেরও এদিকে বেশি দৃষ্টিপাত করা দরকার। তবে দাতারা মনে হয় মিয়ানমারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির বয়ানে মুগ্ধ। সু চি বলে চলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক কি না, সেই প্রমাণ তাদের দিতে হবে। ভোটের হিসাব যে মানবিকবোধকেও বিসর্জন দিতে পারে, সেটাই প্রমাণ করলেন প্রতিবেশী দেশের এই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.