পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব

২৭ মে, ২০১৫ প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিবছরই মাতৃমৃত্যু হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে দেশের অঞ্চলভেদে মাতৃমৃত্যু হারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন খুলনা বিভাগ থেকে সিলেটে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ করতে হবে।
মাতৃমৃত্যু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশের কতগুলো করণীয় রয়েছে। যেমন শিশুবিবাহ বন্ধ করতে হবে। কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতিসেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পিছিয়ে পড়া জেলা ও দরিদ্র মায়েদের প্রসূতিসেবার ক্ষেত্রে দ্রুত বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে। এখন আলোচনা করবেন জাহিদ মালেক।
জাহিদ মালেক
জাহিদ মালেক
মাতৃস্বাস্থ্যের অবস্থা আগে খুব ভালো ছিল না। বর্তমানে এ ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারিনি। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে গিয়েছিলাম। অনেক দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে ছিলেন। এমডিজি অর্জন, প্রজননস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বের চারটি দেশের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে কথা বলার সুযোগ পান। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশকে তারা সম্মানের সঙ্গে দেখে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, বিশেষ করে মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা অল্প টাকায় অনেক বেশি উন্নয়ন করেছি। দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। জাতিসংঘের ধারণামতে, বাংলাদেশে এখন প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ১৭০ জন। বিভিন্ন দেশে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। টিকাদানে বাংলাদেশ বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। প্রতিবছর সাড়ে পাঁচ কোটি টিকা দেওয়া হয়।
ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করে। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবহার করে। এ সবই মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। দেশে চিকিৎসাসেবা সহজতর হয়েছে। প্রতি ইউনিয়নে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এখানে মা ও শিশুরা সেবা নিতে পারে। আমাদের দেশে চিকিৎসা খরচও কম।
দেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় খুবই কম। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় আমাদের থেকে অনেক বেশি। আমেরিকায় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ১২ হাজার ডলার। সেখানে আমরা কোথায় আছি, সেটাও ভাবতে হবে। এখন নারীরা শিক্ষায় অনেক বেশি অগ্রসর। ইউনিয়ন থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত তাঁদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে। অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটছে। এসব নারীর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মাতৃমৃত্যু রোধে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে ক্লিনিকে প্রসবের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে। শিশুবিবাহ বন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের সরকার থেমে নেই। ক্রমাগত এসব ক্ষেত্রে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
রিয়াদ মাহমুদ
রিয়াদ মাহমুদ
নিরাপদ মাতৃত্বের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় আলোচনা করতে চাই। গত বছর জাতিসংঘের ধারণামতে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭০ জন। এ বছরের মধ্যে আমাদের ১৪৩ জনে নামিয়ে আনতে হবে। এক জরিপ অনুসারে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু যদি ১৪৩ জনে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে বছরে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে মাতৃমৃত্যু কমাতে হবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ১৪৩ করতে পারবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
দেশে দক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রসবের হারও বেশ ভালো। ৪২ শতাংশ মা দক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রসব করেন। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব। এটা একটা ইতিবাচক দিক। কিন্তু এর বেশির ভাগই বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। কীভাবে সরকারি হাসপাতালে প্রসবের হার বাড়ানো যায়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তিন হাজার মিডওয়াইফ নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৫০ শতাংশ মা দক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রসব করাবেন। সেটা হয়নি। ৫৮ শতাংশ মা এখনো বাড়িতে অদক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রসব করান।
২০০১ সালে পরোক্ষ কারণে মৃত্যু হয়েছিল ১৫ শতাংশ মায়ের। ২০১০ সালে এটা বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের সব ধরনের সেবার ব্যবস্থা নেই। ৪২ শতাংশ মা মারা যান প্রসবের ছয় ঘণ্টার মধ্যে। ৫৬ শতাংশ মারা যান প্রসবের প্রথম দিন। ৮০ শতাংশ প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু দেশের দরিদ্র মায়েরা বাড়িতে প্রসব করান। কোনো জটিলতা হলে তাঁদের হাসপাতালে আনা সম্ভব হয় না। তাই যেকোনো মূল্যে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়াতে হবে।
দেশের অঞ্চলভেদে মাতৃমৃত্যুর হারের পার্থক্য নিরসন করতে হবে। যেমন খুলনার তুলনায় সিলেটে মাতৃমৃত্যুর হার সাত গুণ বেশি। সরকার ১৩২টি হেলথ কমপ্লেক্সকে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে কাজ করছে। এখানেও সার্বক্ষণিক জরুরি প্রসূতিসেবার ব্যবস্থা নেই। মাতৃমৃত্যু কমাতে হলে শিশুবিবাহ রোধ করতে হবে। প্রজননস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। আমরা ইউনিসেফ এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি।
সামিহা শারমিন
সামিহা শারমিন
আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। আমার গর্ভকালীন তারা অনেক সহযোগিতা করে। ব্যথা অনুভব করলে বৃহস্পতিবার একটি সরকারি হাসপাতালে যাই। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত হয়। ইতিমধ্যে আরও বেশি ব্যথা হয়, খিঁচুনি ওঠে। তখন হাসপাতালের লোকেরা বলে যে এখন আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আগামীকাল শুক্রবার চিকিৎসক আসবেন না। তারপর আমি একটি বেসরকারি হাসপাতালে যাই। স্বাভাবিক প্রসব করা যেত কি না জানি না। আমার সিজার করা হয়। স্বাভাবিক প্রসব করাতে পারলে বড় রকমের একটা খরচ থেকে রক্ষা পেতাম। বেসরকারি হাসপাতালে আমার ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। মাঝেমধ্যে সন্তান অসুস্থ হয়, তারপরও এখন মোটামুটি ভালো আছে।
সামিয়া আফরিন
সামিয়া আফরিন
বরিশালের বরগুনায় কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সেখানে মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের অনেক ভালো ভবন আছে। কিন্তু সেবার মান খুবই খারাপ। গ্রামের নারীদের কাছে কি কখনো জানতে চাই তিনি কোথায় সন্তান প্রসব করাতে চান? গ্রামের মানুষের হাসপাতালের প্রতি একধরনের ভীতি আছে। তাঁরা হাসপাতালে আসতে চান না। তাঁর প্রতিবেশীর কেউ হাসপাতালে ভালো সেবা পাননি।
হাসপাতালের রোগীদের অবহেলাসহ অনেক সমস্যার কথা শোনেন। এভাবে গ্রামের মায়েদের হাসপাতালের প্রতি একধরনের বিরূপ মনোভাব রয়েছে। আবার গ্রামের মায়েরা হাসপাতালে এলেই যে সেবা পাবেন, তার নিশ্চয়তা কী? আমাদের হাসপাতালগুলো কি প্রসূতি মা ও শিশুদের পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত? আমাদের অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। আগে হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। প্রসূতিসেবার ক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশের হাসপাতালগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও অন্য জেলা-উপজেলার অবস্থা খারাপ।
প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় লোকবল ও উপকরণের খুবই অভাব। নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা তাঁর অধিকার। এ অধিকার তাঁকে দিতে হবে। একজন মায়ের গর্ভধারণের আগে-পরে ও গর্ভকালীন মানসম্মত সেবার প্রয়োজন। সেবা দেওয়ার জন্য সরকারেরও ভালো উদ্যোগ আছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ফাঁক থাকছে এবং প্রসূতি মায়েরা সে ধরনের সেবা পাচ্ছেন না।
উপজেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। কিন্তু এ কমিটির কোনো সভা হয় না। ফলে তাদের কোনো তদারক হাসপাতালগুলোতে নেই। হাসপাতালে সেবাদানকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
আর জন্মনিয়ন্ত্রণের সব দায়ভার যেন একমাত্র নারীর। পুরুষের জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণগুলোর প্রচার-প্রসার একেবারে নেই। এ বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হবে।
শামস আল আরিফিন
শামস আল আরিফিন
একজন প্রসূতি মা রোগী নন। কিন্তু একজন চিকিৎসক সারাক্ষণ রোগী দেখে তাঁর দক্ষতা বাড়াচ্ছেন। বেশির ভাগ মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়। হয়তো ১৫ শতাংশের সমস্যা হয়। ফলে প্রসূতি মায়ের সমস্যা হলে কীভাবে এর সমাধান হবে, সে দক্ষতা চিকিৎসকেরা অর্জন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। দক্ষতা অর্জনের সুযোগ খুব জরুরি।
একজন মায়ের অধিকার আছে একটি হাসপাতালে নিরাপদে সন্তান প্রসবের। হাসপাতালে প্রসব বাড়াতে চাই। কিন্তু হাসপাতালগুলোর লোকবল, তাদের প্রসূতিসেবার দক্ষতা, প্রসবের উপকরণ—এসব ঠিক আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদি ঠিক না থাকে, তাহলে হাসপাতালে এসে প্রসবের সঠিক সেবা পাবেন না। এসব কারণে যদি মা সঠিক সেবা না পান বা কোনো কারণে যদি তাঁর মৃত্যু ঘটে, তাহলে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হবে। হাসপাতালের প্রতি নিরুৎসাহিত হবে।
মাতৃমৃত্যুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ রয়েছে। পরোক্ষ কারণে ৩৫ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাতৃমৃত্যুর পরোক্ষ কারণগুলো প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই বা এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের পরোক্ষ কারণে যে ৩৫ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে, সে ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
নমুনা জরিপ দিয়ে মাতৃমৃত্যুর সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না। প্রতি মায়ের মৃত্যুকে হিসাবে আনতে হবে। এভাবে হিসাব না করলে মাতৃমৃত্যুর সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না।
৪২ শতাংশ জন্ম দক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে হচ্ছে। তাঁরা যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানান, তাহলে ৪২ শতাংশ জন্মনিবন্ধন অন্তত সঠিক হয়। সেবাদানকারীদের আইনে বাধ্য করতে হবে জন্মের তথ্যটি কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য।
মো. শহিদুল্লাহ
মো. শহিদুল্লাহ
নবজাত শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি। কিন্তু শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকার সঙ্গে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকা অত্যন্ত জরুরি। গর্ভকালীন মায়ের সেবা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এই সময়ে মায়ের কী কী সমস্যা হয়, সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কেবল চিহ্নিত করলেই হবে না, এসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কত দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটা দেখতে হবে।
বেশি মাকে সেবার আওতায় আনলেই হবে না, তাঁদের পরিপূর্ণ সেবা দেওয়া জরুরি। ভারতে কিছুদিন আগেও সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মা হাসপাতালে সন্তানের জন্ম দিতেন। কিন্তু হঠাৎ করে বেড়ে হলো ৮০ শতাংশ। কারণ, তারা অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে মায়েদের বাড়ি থেকে আনা ও পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পারি। এতে মায়েরা খুব খুশি হন। তাঁরা নিরাপত্তা বোধ করেন। একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে কাজ করছেন? তিনি বললেন, ‘বিকেলে ও রাতে বাসায় থাকি। আয়া ডাকলে হাসপাতালে যাই।’ চিকিৎসক-নার্সদের হাসপাতালে অবস্থান করার বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এটা খুব জরুরি। অধিকাংশ হাসপাতালেই সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়। মিডওয়াইফদের সেবার মাধ্যমে এটা কমে আসবে বলে মনে করি। মিডওয়াইফ নিয়োগের বিষয়ে সরকারের সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এখন যত দ্রুত মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেলে ও রাতে ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকেরা পর্যন্ত রুটিন করে নিয়মিত থাকেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব মা আসেন, তাঁদের প্রায় সারাক্ষণ পরিচর্যার মধ্যে রাখা হয়। মায়েদের কখন কী হয়, প্রায় সবকিছুই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। অন্যান্য হাসপাতাল এভাবে কাজ করলে স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক উন্নয়ন হবে বলে আশা করি।
শামিনা শারমীন
শামিনা শারমীন
৪২ শতাংশ মা প্রসবের ক্ষেত্রে দক্ষ সেবাদানকারীর সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু আমরা মূলত কাজ করছি দরিদ্র মায়েদের জন্য। এই দরিদ্র মায়েদের মাত্র ১৫ শতাংশ হাসপাতালে যাচ্ছেন। ১৮ শতাংশ দক্ষ সেবাদানকারীর সেবা নিচ্ছেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দরিদ্র মায়েরাই বেশি মারা যাচ্ছেন। এ বিষয়টি আমাদের সামনে আনতে হবে। এটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
কিশোরীদের অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ করছে। অল্প বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণের হার দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বেশি। ১৮ বছর বয়সের নিচে বিয়ে বন্ধ করতে পারলে মেয়েরা ২০ বছরের আগে গর্ভধারণ করবে না। চিকিৎসক ও নার্সরা অন্য সব কাজের সঙ্গে প্রসূতি মায়ের দেখাশোনা করেন। ফলে তাঁরা পর্যাপ্ত সময় এসব মাকে দিতে পারেন না।
অন্যান্য দেশে মিডওয়াইফরা খুব দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। একজন মিডওয়াইফ মাকে পূর্ণাঙ্গ সেবা দেন। অর্থাৎ গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী সময়ে যত ধরনের সমস্যা মায়ের হতে পারে, এসবের পূর্ণাঙ্গ সেবা মিডওয়াইফ মাকে দেন। এখন এমডিজি শেষ হচ্ছে। এসডিজি শুরু হচ্ছে। কান্ট্রি সেক্টর প্ল্যান তৈরি হচ্ছে।
হেলথ সেক্টর প্ল্যান তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে মানবসম্পদ স্ট্র্যাটেজিও চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন অন্য যেসব বিষয় বাদ পড়ে গেছে, সেগুলো এ পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় রেফারেল খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো মূল্যে রেফারেল-ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এটা না থাকলে এ সেবায় উন্নয়ন আসবে না। সেবাগ্রহীতারা নিরাপত্তা বোধ করবেন না। স্বাস্থ্যসেবার প্রতি ক্ষেত্রে রেফারেল সিস্টেম থাকতে হবে।
মোহাম্মদ শরীফ
মোহাম্মদ শরীফ
প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। দেড় বছর আগে এর জন্য বড়ি কেনা হয়েছে। এ বড়ির মাধ্যমে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। চার জেলায় ৮০ শতাংশ ফ্যাসিলিটি ডেলিভারি হচ্ছে। মা-মণি প্রকল্প ও প্ল্যানের সঙ্গে কাজ করে ৮০ শতাংশ ফ্যাসিলিটি ডেলিভারি করছি। মিডওয়াইফের জন্য আমাদের কাজ কিন্তু থেমে নেই।
আজ যে ৪২ শতাংশ ফ্যাসিলিটি ডেলিভারি হচ্ছে, এর জন্য সবাই কাজ করছে। মিডওয়াইফের কাজও আমাদের মধ্য থেকে হচ্ছে। আমাদের এফডব্লিউভিরা (ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর) ১২ মাসের পরিবার পরিকল্পনা প্রশিক্ষণ নেয়। ছয় মাসের মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ নেয়। এখন জাইকার সহযোগিতায় আরও ছয় মাসের মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমাদের কর্মীরা সব দিক দিয়ে দক্ষ হয়ে উঠছেন। কাজের মানও আগের তুলনায় ভলো হচ্ছে। তবে তদারকের বিষয়ে আরও কিছুটা জোর দিতে হবে। তাহলে কাজের মান আরও বাড়বে। সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে আনার বিষয়টিও ভাবতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আগামী স্বাস্থ্যসেবার আরও অনেক উন্নয়ন হবে বলে আশা করি।
মোমেনা খাতুন
মোমেনা খাতুন
আমরা ২৪ ঘণ্টা সেবার কথা আলোচনা করছি। সত্যিকার অর্থে এটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা যতই বলি না কেন, এটা নিশ্চিত করা সত্যি কঠিন একটি কাজ। ২৫ বছর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কাজ করেছি। তখন আমরা মা-মণি প্রকল্পে এ সেবা চালু করেছিলাম। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন আরেকটি বিষয় হলো, আমার কি সেবাকেন্দ্র বাড়াব, নাকি সেবার মান বাড়াব? এ বিষয়ে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে।
সেবাকেন্দ্রে তিনটি পেয়ার (জোড়া) কাজ করানো খুবই কঠিন। এ ক্ষেত্রে একটা সমাধান বের করতে হবে। আমাদের প্যাকেজ–সেবার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কেউ কোনো কিছুর অভাবে বসে না থাকে। মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা শেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে যাচ্ছি। এই পর্যায়ে আমাদের সেবার মান কী হবে, সেটা ভাবতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে, এফডব্লিউসিতে কতটা মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারছি, সেটা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। রেফারেলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসব সেবাকেন্দ্রে যারা আসে, তারা আমাদের একান্ত আপনজন—এভাবে চিন্তা করতে হবে।
কানাডা সরকার মা ও শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করি।
আন ইউনিয়ং
আন ইউনিয়ং
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ চিকিৎসক ও নার্স থাকার কথা, সেটা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমি শিশু চিকিৎসক। আমি বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। সেসব দেশে নার্সরা তিন শিফটে কাজ করেন। এক শিফট চলে যাওয়ার সময় অন্য শিফটের কোথায় কী সমস্যা আছে, সেটা বুঝিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এটার খুবই অভাব। নার্স খুব কম সময় দেন বলে তাঁরা রোগীদের সব অবস্থা জানতে পারেন না। ফলে নার্সদের মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীদের সমস্যা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেন না। নার্সদের কথা বলার অধিকার, কাজের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
কোয়েকা বাংলাদেশে প্রথম নার্সদের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু করতে যাচ্ছে। আগামী বছর থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নার্সদের পড়াশোনা শুরু হবে। নার্সদের সম্মানের জায়গা বৃদ্ধি করলে কাজের প্রতি তাঁদের মনোযোগ আরও বেশি হবে। বাংলাদেশের নার্সদের ব্যাপারে কোয়েকা বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে।
উম্মে সালমা জাহান
উম্মে সালমা জাহান
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বলে দিচ্ছে আমরা মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে ভালো করেছি। তবে আরও অনেক বেশি ভালো করার সুযোগ রয়েছে। আরও ভালো করতে পারলে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সহজ হবে।
আমরা ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। সারা বাংলাদেশে চার শতাধিক সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিক আছে। ইউএসএআইডির সহযোগিতায় এসব ক্লিনিক পরিচালিত হয়।
মা-মণি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে স্থানীয় যে কমিটি আছে, সে কমিটিগুলোকে কার্যকর রাখার ক্ষেত্রে আমরা কাজ করি। আমাদের পরিচালিত সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি পরিবার পরিকল্পনা এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করছে। এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের মূল বিষয় ‘পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব’।
পরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্বের চারটি স্তম্ভ আছে। এর প্রথমটি হলো পরিবার পরিকল্পনা। পরিকল্পিত জন্মের জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন না হলে দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্জন ধরে রাখতে পারব না। এ পর্যন্ত মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে আমাদের অর্জন খারাপ না। এ ক্ষেত্রে যদি গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে সামনে আরও উন্নয়ন করা কঠিন হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে হলে দক্ষ জনবলের কোনো বিকল্প নেই। অনেকে এ বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন। তবে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তথ্য-উপাত্ত খুব জরুরি। স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু জরিপ আমরা করি। এসব জরিপ থেকে বুঝতে পারি কোন ক্ষেত্রে কী করা প্রয়োজন।
রওশন আরা
রওশন আরা
একজন ভালো মায়ের জন্য একজন ভালো কিশোরী দরকার। কিশোরীদের স্বাস্থ্যের বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখি না। আমাদের স্কুল-কলেজ, হাটবাজার বা শহরের বিপণিবিতান মার্কেটগুলো কোনোটাই কিশোরীবান্ধব না। একটা কিশোরীর ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হচ্ছে। আমি তাকে বললাম, তুমি ২০ বছরের আগে সন্তান নেবে না। এই পাঁচ বছর সে জন্ম নিরোধের জন্য কী ব্যবহার করবে? অনেকে বড়ি খেতে পারে না, ইনজেকশন নিতে পারে না, কপারটি ব্যবহার করতে পারে না, এসবে তার সমস্যা হয়। তাহলে এই মেয়েটির জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কী আছে? খুব বেশি নিরাপদ তেমন কিছু কিন্তু দেখি না। এ ক্ষেত্রে সবাইকে ভাবতে হবে।
ছেলেরাও যাতে জন্মনিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব নিতে পারে, সেটিও আজ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সব দায়িত্ব একজন নারীর না। মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। রক্তের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য কিউ ম্যাট। কিন্তু আমরা রক্তক্ষরণ হতে দেব কেন?
যেসব মা বাড়িতে ধাইয়ের মাধ্যমে প্রসব করান, তাঁরা খুব সহজে মিজো প্রস্টল বড়ি কাছে রাখতে পারেন। মাকে এটা খাওয়ালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে। এটা বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়। এ বড়ি রাখার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না।
মিজো প্রস্টল বড়ির ব্যাপারে সবাই সচেতন থাকলে মৃত্যুর একটা বড় কারণ রোধ করা সম্ভব। মাতৃমৃত্যুর আর একটা বড় কারণ উচ্চরক্তচাপ। ম্যাকসাল ইনজেকশন দিয়ে এটা বন্ধ করা যায়। আপাতত এ ইনজেকশন দিয়ে তাঁকে রেফারেলের ব্যবস্থা করতে হবে।
রেফারেলের ব্যবস্থা থাকাটা খুবই জরুরি। উচ্চরক্তচাপ বন্ধের জন্য জাতীয়ভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একটা মানসম্পন্ন ওষুধ ঠিক করবেন, যেটা সবাই ব্যবহার করবেন। এখন যাঁর যেটা মনে হচ্ছে, সেটা ব্যবহার করছেন। সবাই মিলে চেষ্টা করলে উচ্চরক্তচাপ বন্ধ করা সম্ভব। আবার গর্ভকালীন সচেতন থাকলে জন্ডিস প্রতিরোধ করা যায়। জনবল যে একেবারে কম আছে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তদারকব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যে জন্য আমরা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারছি না।
জাহিদ মালেকদিকনির্দেশনামূলক আলোচনা হয়েছে। অনেক মতামত ও সুপারিশ এসেছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। প্রতিটি কাজের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হয়। এ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা আছে, সেটা আপনারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছেন।
সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক করেছে। এটা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা তৈরি না করলে কোথায় লোকবল দেবেন? কোথায় স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ দেবেন? সরকার ৬ হাজার ৫০০ চিকিৎসক নিয়োগ করেছে। আরও নিয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে। ১০ হাজার নার্স নিয়োগের অনুমোদন পাওয়া গেছে। ১০ থেকে ১২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ হচ্ছে।
কোনো একজন মা গর্ভধারণ থেকে প্রসব পর্যন্ত যেন কমপক্ষে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকেন, সে ব্যাপারে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। অ্যানেসথেটিস্ট নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। আমাদের কমিটিতেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ৩ হাজার ২০০ সিনিয়র চিকিৎসকের পদ আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫০০ পদ খালি। অ্যানেসথেটিস্ট প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ জন। পদ আছে ৫০০ জনের। বর্তমানে কাজ করছেন ২৫০ জন। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, আমরা উদ্যোগ নেব।
শিক্ষার অভাব ও দারিদ্র্য—এ দুটি বিষয় সমস্যা করছে বেশি। যে সমাজে এ দুটি সমস্যা রয়েছে, সেখানে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বেশি। সেখানে বাল্যবিবাহ বেশি। এ বিষয়ে আমাদের আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন বেশি হয়। প্রায় ৮০ শতাংশ অপারেশন হয় বেসরকারি হাসপাতালে। সবাই জানি কেন হয়? এখানে আর্থিক বিষয় জড়িত। এ দিকটি আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।
যেসব এলাকায় মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বেশি, সেখানে ব্যবস্থা নেব। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য আমাদের দেশে চিকিৎসকসহ ছয়জন সেবাকর্মী আছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই সংখ্যা ২৩ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২৭ জন প্রয়োজন। চীনে আছেন ২৪ জন। ইউরোপে ৬০ জন। স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা না বাড়ালে আমরা কীভাবে সেবা দেব? এ বিষয়টি ভাবতে হবে।
মিডওয়াইফ বিশ্বে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মা ও শিশু, কিশোরী সবাইকে তাঁরা প্রয়োজনীয় সেবা দেন। ৮৭ শতাংশ সেবা মিডওয়াইফরা দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে আমাদের দেশে মিডওয়াইফের সেবা শুরু হতে যাচ্ছে।
আব্দুল কাইয়ুমপরিকল্পিত জন্ম ও নিরাপদ মাতৃত্ব আমাদের সবার কাম্য। এ জন্য প্রয়োজন হাসপাতালগুলোর প্রসূতি ও প্রসবজনিত সেবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। পর্যাপ্ত জনবল ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে মায়েরা সঠিক সেবা পাচ্ছেন না বলে আলোচনায় এসেছে।
সঠিক তদারকী না থাকায় সেবাদানকারীরা ঠিকভাবে কাজ করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। সেবাদানকারীদের জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেকে জোর দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
শতাংশ মা হাসপাতালে প্রসব করেন
মাতৃমৃত্যু রোধে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রসবের হার বাড়াতে হবে
* এখন প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু হয় ১৭০ জনের
* মাতৃ–স্বাস্থ্যসেবার হার বাড়লেও গুণগত মান বাড়েনি
* সিলেট বিভাগে মাতৃমৃত্যুর হার খুলনা বিভাগ থেকে সাত গুণ বেশি, তাই অঞ্চলভিত্তিক কৌশল নিতে হবে
* সব জেলা ও নির্দিষ্ট উপজেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতি সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
* শিশুবিবাহ ও কৈশোরে গর্ভধারণ বন্ধ করতে হবে
সূত্র: বিএমএমএস, বিডিএইচএস ২০১৪, যৌথ জাতিসংঘ প্রতিবেদন ২০১৩
আলোচনায় সুপারিশ
* মাতৃমৃত্যু রোধে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে ক্লিনিকে প্রসবের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে। শিশুবিবাহ বন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।
* একজন মাকে জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়ার জন্য অ্যানেসথেটিস্ট ও টেকনিক্যাল জনবল দরকার। সব হাসপাতালে এটা নিশ্চিত করতে হবে
* হাসপাতালে সেবাদানকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে
* প্রথম প্রয়োজন হাসপাতালগুলোকে মানসম্পন্নভাবে গড়ে তোলা
* চিকিৎসক-নার্সদের হাসপাতালে অবস্থান করার বিষয় নিশ্চিত করতে হবে
যাঁরা অংশ নিলেন

জাহিদ মালেক : প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
মোহাম্মদ শরীফ : পরিচালক, (মা ও শিশু) লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
রওশন আরা : সভাপতি, ওজিএসবি
মো. শহিদুল্লাহ : বিভাগীয় প্রধান, নিয়োনাটালজি, বিএসএমএমইউ
আন ইউনিয়ং : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কোয়েকা
মোমেনা খাতুন : সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ডিফ্যাটডি, কানাডা
শামিনা শারমীন : ম্যাটারনাল হেলথ স্পেশালিস্ট, ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ
উম্মে সালমা জাহান : ইউএসএআইডি
সামিয়া আফরিন : প্রকল্প ব্যবস্থাপক, নারীপক্ষ
রিয়াদ মাহমুদ : স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ
শামস আল আরিফিন : পরিচালক, আইসিডিডিআরবি
সামিহা শারমিন : হাসপাতালে সেবাপ্রাপ্ত সন্তানের মা, পশ্চিম আগারগাঁও
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.