সমাধান হলো মানচিত্রের অসঙ্গতি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিকে বার্লিন পতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন মোদি। কিন্তু ছিটমহল নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছা এক জিনিস, আর দুদেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াত সমপূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বৃটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রাঙ্কনে বেশ কিছু অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে। তবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের যে ব্যাপ্তি, তার চেয়ে অদ্ভুত খুব কমই আছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল। তখন থেকেই সীমান্তের উভয় পাশে ১৬২টি খণ্ড খণ্ড জমি, যেগুলো বস্তুত সীমান্তের অপর পাশের দেশটির মালিকানাধীন। ৬ই জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে ওই অসঙ্গতি এখন সমাধানের পথে। ওই ছিটমহলগুলো দেশভাগের আগেও যার যার জায়গায় ছিল। কথিত রয়েছে, কয়েক শতাব্দী আগে ২ মহারাজার মধ্যে দাবা খেলার ফলেই ওই ছিটমহলগুলোর সৃষ্টি। মহারাজদ্বয়ের দাবা খেলার বাজি ছিল জমির টুকরোগুলো। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ব্রেন্ডন হোয়াইট অবশ্য বিশ্বাস করেন, বৃটিশদের আবির্ভাবের আগে ১৮ শতাব্দীর দিকে কোচবিহারের মহারাজা ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে কয়েকটি চুক্তির ফলে জন্ম হয়েছে ছিটমহলগুলোর। বিশ্বের মধ্যে একমাত্র ওই অঞ্চলেই পাল্টাপাল্টি ছিটমহলের (কাউন্টার-কাউন্টার এনক্লেভ) অস্তিত্ব রয়েছে। বাংলাদেশী ভূখণ্ডের মধ্যে এক খণ্ড ভারত অর্থাৎ বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিটমহল। আবার একইভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী ছিটমহল।
মোদি বিমান থেকে অবতরণের পর হাসিনা তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্র বলে পরিচিত ভারতের নেতার কাছ থেকে অনুমোদনের দলিল গ্রহণের জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সফরের সময় মোদি ২০টির মতো অন্যান্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত পেরিয়ে বাস সেবা, জ্বালানি খাতে বিনিয়োগসহ আরও অনেক কিছু।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে সাহায্য করার জন্য ভারতকে বাংলাদেশে একসময় সাদরে গ্রহণ করা হতো। কিন্তু এরপর থেকে অনেক বাংলাদেশী দেশটিকে কতৃত্বপরায়ণ, এমনকি বিদ্বেষী বিমাতা হিসেবে বিবেচনা করে। মোদির সফরের উদ্দেশ্য ছিল, এটা দেখানো যে, ভূখণ্ড, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে বিরোধ জিইয়ে রাখার বদলে আরও বাণিজ্য ও আস্থার মাধ্যমে দুদেশের সমপর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
বহু দশকের দ্বিধার পর, উভয় দেশ নিজেদের মধ্যকার সীমান্তের উদ্ভট সমস্যা দূর করতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত, ছিটমহলে বসবাসকারী ৫০ হাজার মানুষ কার্যত রাষ্ট্রহীন। তারা এমন কিছ ভূখণ্ডের বাসিন্দা, যেখানে নেই কোন বিদ্যালয়, হাসপাতাল বা আদালত। এখন তাদের যে কোন এক দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। সঙ্গে রয়েছে নাগরিকত্বসহ মৌলিক সুবিধাদি। পুরো চুক্তিটি হংকং দ্বীপের অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট অঞ্চলকে নিয়ে।
মোদি বলেন, ছিটমহল নিয়ে এ চুক্তিটির গুরুত্ব বার্লিন দেয়াল পতনের সমান গুরুত্ব বহন করে। তবে সীমান্তের অন্যত্র ভারতের কার্যকলাপ এ ধরনের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্যের সঙ্গে যায় না। অভিবাসী ও চোরাচালানিদের উপদ্রব ঠেকাতে সীমান্ত যতদূর সম্ভব কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলতে ব্যস্ত দেশটি। জানুয়ারি ও মে মাসের মধ্যে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় ২০ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। ছিটমহল নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছা এক জিনিস। কিন্তু দুদেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াত সমপূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

No comments

Powered by Blogger.