গায়েবি ভোটের ময়নাতদন্ত- যেভাবে ৬১ ভোট হয়ে যায় ৩৮১ by সিরাজুস সালেকিন

একই কেন্দ্রের দুই রকম ভোট চিত্র। প্রিজাইডিং অফিসারের স্বাক্ষরযুক্ত এক রেজাল্টশিটে প্রার্থী এস এম এরশাদ উল্লাহ পেয়েছেন ৬১ ভোট, যা দেয়া হয়েছে এজেন্টদের। কিন্তু একই কেন্দ্রের অপর এক রেজাল্টশিটে এস এম এরশাদ উল্লাহর প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছে ৩৮১। চট্টগ্রাম হালিশহর হাউজিং এস্টেট, ৪৭১ ডিউ পয়েন্ট স্কুল, কেন্দ্র-২-এ ঘটেছে এমন ঘটনা। ওই কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ১৯৪১। এর মধ্যে ৬৭০ জন ভোট দিয়েছেন। যার মধ্যে বাতিল হয়েছে ৩২৭ ভোট। আর ৩৪৩ ভোটের মধ্যে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে লড়াই করা আবদুস সবুর লিটন পেয়েছেন ২৪ ভোট। লাটিম প্রতীকের এস এম এরশাদ উল্লাহ পেয়েছেন ৬১ ভোট। মিষ্টি কুমড়া প্রতীক নিয়ে ফয়েজ আহামদ পেয়েছেন ৩২ ভোট। আর শহীদ মো. চৌধুরী ঘুড়ি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২২৬ ভোট। এমন তথ্য দিয়ে নির্বাচন শেষে ভোট গণনার পর প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ আবুল বশর তার স্বাক্ষর দিয়ে এজেন্টদের ভোট গণনার বিবরণী সরবরাহ করেন। এজেন্টরা তা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু এর পরের চিত্র অন্য রকম। একই প্রিজাইডিং অফিসার সবার ভোট ঠিক রেখে এস এম এরশাদ উল্লাহর ভোট দেখান ৩৮১টি। ৬১ ভোট হয়ে যায় ৩৮১ ভোট। গায়েবি এ ভোটের চিত্র দেখে হতবাক সবাই। এ ব্যাপারে আবদুস সবুর লিটন চট্টগ্রাম রিটার্নিং অফিসার বরাবর আবেদনও করেন। গতকাল দিনভর অনিয়ম, কারচুপির প্রমাণসহ অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের দাখিল করা অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের জেতানোর জন্য নানা কৌশলে ভোটের হিসাব বদলানো হয়েছে। প্রার্থীদের ভোটের হিসাব বদলাতে যোগ করা হয়েছে বাতিল ভোট। প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থীরা তাদের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জানাতে পারেন। এখানে কমিশনের কিছু করার নেই। তারা ট্রাইব্যুনালে বিচার পাবেন।  চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের হালিশহর হাউজিং এস্টেট কেন্দ্র ২-এর প্রিজাইডিং অফিসার স্বাক্ষরিত ফলাফলে ২৪ ভোট পেয়েছিলেন টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আবদুস সবুর লিটন। একই কেন্দ্রে লাটিম প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী এস এম এরশাদ উল্লাহ পেয়েছেন ৬১ ভোট। সব কেন্দ্রের ফল যোগ করার পর তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১২৫ ভোট পেয়ে জয়ী হন। কিন্তু রিটার্নিং অফিসার ঘোষিত ওই কেন্দ্রের ফলাফলে ভোটের হিসাব পাল্টে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। গতকাল নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, চূড়ান্ত ফলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এসএম এরশাদ উল্লাহর লাটিম প্রতীকে ৩৮১ ভোট দেখিয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এই ভোটের পরিমাণ বাড়াতে বাতিল ভোট যোগ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে নির্বাচন কমিশনের গেজেটে এই ফলাফল না প্রকাশ করার জন্য আবেদন করেছেন আবদুস সবুর লিটন। এজন্য উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি। ঢাকা দক্ষিণের ৫৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মনির হোসেন অভিযোগ করেছেন, তার ২০টি কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোট ৩৪৮৯ দেখানো হয়েছে। অথচ তার ১৪টি কেন্দ্রেই প্রাপ্ত ভোট ৩৮২৭। বাকি ৬টি কেন্দ্রের ফল প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি লিখিত অভিযোগে আরও বলেন, রাত দশটা পর্যন্ত রেজাল্ট ঘোষণা না করে এজেন্টদের বের করে দিয়ে রেজাল্ট শিট ওলটপালট করা হয়েছে। ভোট গণনার পূর্বেই তার পোলিং এজেন্টদের কাছ থেকে রেজাল্ট শিটে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এরপর প্রিজাইডিং অফিসাররা পছন্দমত রেজাল্ট শিট তৈরি করেছেন। এজন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট পুনঃগণনার আবেদন করেছেন মনির হোসেন। এছাড়া চট্টগ্রামের ১নম্বর সংরক্ষিত নারী আসনে কেটলি প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী ফেরদৌস বেগম মুন্নী অভিযোগ করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে কেন্দ্র দখল করে। এরপর ব্যালট সংগ্রহ করে নিজ প্রতীকে সিল মেরে বাক্স ভরেছেন। বাক্সে থাকা  কেটলি প্রতীকের ভোট নর্দমায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এজন্য গেজেট প্রকাশ স্থগিত করে পুনঃনির্বাচনের আবেদন করেছেন তিনি। চট্টগ্রামের ৮ নম্বর সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর আসনের আরেক প্রার্থী রেখা আলম চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কেন্দ্র দখল করে সিল মেরেছেন। তিনি তাৎক্ষণিক রিটার্নিং অফিসারকে বিষয়টি জানিয়ে ফলাফল স্থগিতের আবেদন করলে তা রাখা হয়নি। রিটার্নিং অফিসার ফল ঘোষণা করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী শামীমা আক্তার সোমা অভিযোগে বলেন, ভোটকেন্দ্রে জালভোট দেয়ার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। এসময় তাকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। পুলিশের সাহায্য চাইলে তারা সরকারি দলের কর্র্মীদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না বলে জানায়। কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালে তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রশাসন ও ভোট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিনি কোন প্রকার সাহায্য পাননি। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে অবগত করে পুনঃনির্বাচনের দাবি করেছেন ওই নারী কাউন্সিলর প্রার্থী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার একজন কাউন্সিলর প্রার্থী জানান, ভোটে জয়ের জন্য তিনি পুলিশের সঙ্গে ১১ লাখ টাকায় চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ২০ লাখ টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে। ভোট গণনার সময় তার প্রতীকে সিল দেয়া ব্যালটগুলো বাক্স থেকে বের করে ফেলে দেয়া হয়। এরপর নতুন ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে।
ভোটের দিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ইসি সচিবালয়ের পর্যবেক্ষকরাও!
ভোট গ্রহণের দিন ইসি সচিবালয়ের নিজস্ব ৫৮ জন কর্মকর্তা ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেছে সরকারদলীয় প্রার্থীর কর্মী, পুলিশসহ ভোট কর্মকর্তারা। দুজন কর্মকর্তার ল্যাপটপ ও ওয়েবক্যাম ছিনিয়ে নেয়া হয়। এছাড়া একজন পর্যবেক্ষকের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে তার ছবি মুছে ফেলেন সরকার দলীয় এমপি এখলাস উদ্দিন মোল্লা। কয়েকটি কেন্দ্রে পুলিশ ও প্রিজাইডিং অফিসাররা পর্যবেক্ষকদের ঢুকতে দেননি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কাছে এমন কোন তথ্য নেই। ওই পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট তিনি পাননি।
নির্বাচনী অনিয়ম তদন্তে সরকার ও ইসিকে বাইরে রাখতে হবে: এম. সাখাওয়াত হোসেন
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) বাইরে রাখতে হবে। গতকাল বিবিসিকে এ কথা বলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, যে যা-ই করুক, দিনের শেষে এটা নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব। সাধারণত, এ ধরনের অনিয়মের তদন্ত কিন্তু নির্বাচন কমিশনই করে থাকে। কিন্তু এখানে এখন প্রশ্নটা হলো যে, তদন্তটা কে করবে? সরকারও করতে পারবে না। ইলেকশন কমিশনের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে, আমি মনে করি, যেহেতু এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তাহলে সে অভিযোগের তদন্ত আসতে হবে উচ্চ আদালত থেকে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, নির্বাচন কমিশন দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক ধরনের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। তাহলে তদন্ত করতে হলে, এ নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে স্থগিত রাখতে হবে। স্থগিত করে তদন্ত করার পরে একটা সিদ্ধান্ত আসবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়, বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ উঠেছে, সেটির সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এ নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচনে তদন্তের বিষয়ে তারা যে তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে, সেটি কিভাবে সম্ভব? এ নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব কেমন?
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের দিক থেকে যে বক্তব্যগুলো এসেছে, তা মোটামুটি একই রকম। তারা সকলেই নির্বাচনে কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ তদন্ত কে করবে? নির্বাচন কমিশন যদিও বলছে, নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোন অভিযোগ আইনানুযায়ী তাদেরই তদন্ত করার কথা। কিন্তু এ নির্বাচনে খোদ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই নিষ্ক্রিয়তা আর ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। তাহলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা কি নিজের তদন্ত নিজেই করবে? নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলছেন, তারা শুধু স্থগিত হওয়া তিনটি কেন্দ্রের বিষয়ে তদন্ত করবেন। নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক এবং আন্তর্জাতিক মহল যেভাবে সমালোচনা করছে, সেটি খানিকটা অস্বস্তি তৈরি করেছে সরকারের ভেতর। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে ব্যাপক তদন্তের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে তেমন চিন্তা ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অভিযোগের তদন্ত হবে। তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন যেভাবে তদন্তের কথা বলছেন, সে রকম তদন্ত করার কোন আগ্রহ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন, আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত যদি তদন্ত হয়েও থাকে, তাহলেও সেটি কতটা কার্যকরী তদন্ত হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.