জিয়ার মাজারে ভাঙচুর

মার্বেল পাথরের ১৭টি টুকরো। এলোমেলোভাবে পড়ে আছে বেদির ওপর। তুলে ফেলা হয়েছে ৬টি প্লেট। আংশিক ভাঙচুর করা হয়েছে ৫টি। এমন দৃশ্য দেখা গেছে, রাজধানীর শেরেবাংলানগরস্থ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে। বুধবার রাতে সমাধিস্থলের বাইরে বৃত্তাকার বেদির ওপর কারুকাজের প্লেটগুলো এভাবেই ভাঙচুর করে ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উদ্যানের চার তত্ত্বাবধায়ককে আটক করেছে পুলিশ। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণেই দুর্বৃত্তরা নিন্দনীয় এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি মানবজমিনকে বলেন, সিটি নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির কারণে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তারা হয়তো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এই ঘৃণ্য কাজটি করেছে। জানা গেছে, গতকাল সকালে দর্শনার্থীরা প্রথম ভাঙচুরের দৃশ্য দেখতে পান। পরে তারা উদ্যানের পরিচ্ছন্নতা কর্মী মিজানুর রহমানকে জানান। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে খবর দেন। মিজানুর রহমান জানান, প্রতিদিনের মতো আমি ঝাড়ু দিতে এসে দেখি, মাজারের চারপাশের ভাঙা মার্বেল পাথর পড়ে আছে। শক্ত কিছু দিয়ে সেগুলো ভাঙা হয়েছে বলে আমার ধারণা। এই দৃশ্য দেখে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে খবর দেই। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জানতে চাইলে মিজান বলেন, আমি ভোর ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত কাজ করি। অন্যান্য দিনের মতো গতকালও ঝাড়ু দিতে এলে দর্শনার্থীরা আমাকে ভাংচুরের ঘটনাটি জানান। এ ব্যাপারে আর কিছু জানি না। এদিকে গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বেলা সোয়া ১২টার দিকে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি গণেশ গোপাল বিশ্বাস ঘটনাস্থলে যান। এরপর তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের অফিসে খবর দেন। বেলা ১টার দিকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগের একজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হন। তার নির্দেশে সংস্থার দুই কর্মচারী আঙ্গুর ও তুহিন ভাঙা মার্বেল পাথরগুলো জায়গামতো বসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এসময় পুলিশ উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক চারজনকে আটক করে শেরেবাংলা থানায় নিয়ে যায়। এ বিষয়ে গণেশ গোপাল বিশ্বাস জানান, চন্দ্রিমা উদ্যানের দায়িত্বে রয়েছে পিডব্লিউডি। তারাই এখানে পাহারা দেয়। এ ঘটনার পেছনে তাদের দায়িত্বে অবহেলা বা তাদের কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না তা তদন্ত করছে পুলিশ। এজন্য পিডব্লিউডি’র চারজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি বলে জানান ওসি। জিয়াউর রহমানের মাজারে গিয়ে দেখা গেছে, মূল সমাধিস্থলকে ঘিরে বৃত্তাকার বেদির ওপর গাম দিয়ে বসানো ১১টি মার্বেল পাথরের প্লেট তুলে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। আরও কয়েকটি প্লেট ভাঙার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। সেগুলো তুলতে পারেনি। মাজার প্রাঙ্গণে পালা করে দায়িত্ব পালন করেন পুলিশ ও আনসার সদস্য। এছাড়া ৫শ’ গজ দূরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন। মাজারের ১০০ গজ  উত্তরে একটি মসজিদ ও মেমোরিয়াল হল রয়েছে। মসজিদে রাত্রি যাপন করেন মুয়াজ্জিন। তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। ভাঙচুরের খবর পেয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মী, সমর্থকরা ও উৎসুক মানুষরা ভিড় করেন মাজার প্রাঙ্গণে। কেউ ছবি তুলেন। আবার কেউ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মাজার প্রাঙ্গণে দায়িত্ব পালনকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, নিরাপত্তার জন্য মাজারের ওপরের চাদোয়ায় বসানো সিটি ক্যামেরাগুলোতে মরিচা পড়ে গেছে। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না করা কারণে অচল হয়ে পড়েছে ক্যামেরাগুলো।  জ্বলে না মাজার প্রাঙ্গণের লাইটগুলো। রাত হলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায় ওই এলাকাটি। কর্তৃপক্ষের অবহেলার জন্য এই ঘটনাটি ঘটেছে। অপর আনসার সদস্য জামান বলেন, ২০ জন আনসার সদস্য পালা করে উদ্যানে দায়িত্ব পালন করেন। চারজন সদস্য প্রতি ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি করেন। এছাড়া পুলিশ সদস্যরা মাজার এলাকায় পালা করে দায়িত্ব পালন করেন। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি বেলা ১২টা থেকে ডিউটি করছি। রাতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সরকারের দায়িত্বহীনতায় দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর করেছে: বিএনপি
সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণেই সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। গতকাল বিকাল ৫টায় মাজার প্রাঙ্গণ পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের তিনি এ অভিযোগ করেন। রিপন বলেন, জিয়াউর রহমানের মাজার ভাঙচুরের ঘটনা গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জেনেছি। তিনি সেক্টর কমান্ডার ও সর্বোচ্চ বীরউত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এছাড়া তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন। তার মাজার ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, উদ্যান ও জাতীয় নেতাদের মাজার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের গণপূর্ত বিভাগের। তাদের দায়িত্বহীনতার কারণেই দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা আশা করবো- যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে অবিলম্বে সরকার তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনবে। এদিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, রাতের আঁধারে জিয়াউর রহমানের মাজারের বৃত্তাকার কিছু অংশ দুর্বৃত্তদের ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। সরকারের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। মাজারের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনর্নির্মাণসহ সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য সকল জাতীয় সমাধি সৌধগুলোর মর্যাদা রক্ষারও আহবান জানাচ্ছি। এর আগে বেলা ৩টার দিকে মাজার প্রাঙ্গণে যান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রাতের অন্ধকারে জিয়াউর রহমানের মাজারের ১১টি টাইলস ভাঙচুর করার ঘটনা মূলত তার সমাধির ওপর আক্রমণ বলেই আমরা মনে করি। এটা দূরভিসন্ধিমূলক এবং ষড়যন্ত্রের অংশ। জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ও  দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যারা তার মাজার ভাঙচুর করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। এসময় তার সঙ্গে মাজার পরিদর্শনে যাওয়া ২০ দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, জিয়াউর রহমানের মাজার নিয়ে রাজনীতি করা একটি ঘৃণ্য কাজ। আমি মনে করি, জিয়াউর রহমানের মাজারে হামলা করে দুর্বৃত্তরা দেশের সব মুক্তিযোদ্ধার কবরে হামলা করেছে। এছাড়া বেলা সাড়ে ১২টার মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, আবুল হোসেনসহ কয়েকজন মাজার প্রাঙ্গণে যান। এদিকে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজী জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, গণভবনের কাছে এত নিরাপত্তার মধ্যে একদল দুর্বৃত্ত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধি প্রাঙ্গণে ভাঙচুর চালিয়েছে। আমরা এর কঠোর নিন্দা জানাই। দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি আমরা। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরদিন তার লাশ চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে দাফন করা হয়। সেখান থেকে ১লা জুন লাশ ঢাকায় এনে জানাজা শেষে তৎকালীন চন্দ্রিমা উদ্যানে দাফন করা হয়। পরবর্তী এই উদ্যানটি জিয়া উদ্যান হিসেবে নামকরণ করা হয়। জিয়াউর রহমানের মূল সমাধির নকশা করেছিলেন প্রয়াত স্থপতি রাজিউল আহসান। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে এই সমাধি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.