আনসারের জ্যাকেট পরে নির্বাচনী দায়িত্বে কিশোর–তরুণ, যাচাই না করে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন

হালফ্যাশনের পোশাকের ওপর চাপানো আনসারের জ্যাকেট। ওই জ্যাকেট পরা তরুণের নাম মাসুম। রাজধানীর মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। গত মঙ্গলবার সে ঢাকা সিটি কলেজ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিল।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মঙ্গলবার নগরের বিভিন্ন কেন্দ্রে এমন অনেক তরুণ-তরুণীকে আনসার-ভিডিপির জ্যাকেট গায়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে দেখে গেছে। এদের কেউ কেউ কৈশোরও পেরোয়নি। সঠিকভাবে যাচাই না করে আনসারের মতো একটি বাহিনীর পোশাক দিয়ে তাদের কী করে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদের নিয়োগ দেওয়ায় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, এদের অনেকে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতাদের মাধ্যমে এ দায়িত্ব পেয়েছে।
জানতে চাইলে আনসারের ঢাকা জেলা কমান্ড্যান্ট নুরুল হাসান ফরিদী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, যারা নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব পালন করেছে, তারা স্বেচ্ছাসেবক। এঁরা বাহিনীর নিয়মিত সদস্য নয়। শুধু নির্বাচনের চার দিন তারা দায়িত্ব পালন করে। এর জন্য ভাতা পায়। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক সহজে পাওয়া গেলেও শহরে এত স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যায় না। এ কারণে যারা আসতে রাজি হয় তাদেরই আনা হয়। এ ক্ষেত্রে কারও দল ও অন্য পরিচয় বড় করে দেখা হয় না। তিনি বলেন, এরা পুলিশের অধীনে দায়িত্ব পালন করে। সে কারণে লাঠি হাতে নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার থাকে না।
মঙ্গলবার ভোট গ্রহণের সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা দেখতে পান, বিভিন্ন কেন্দ্রে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা আনসার-ভিডিপির জ্যাকেট গায়ে দায়িত্ব পালন করছে। দেখেই বোঝা যায়, তারা আনসার বাহিনীর নিয়মিত সদস্য নয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, আনসার ও ভিডিপির পোশাকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী ও তাদের মনোনীত লোকজন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন। এদের বিরুদ্ধে জাল ভোট দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগও উঠেছে।
যেসব কেন্দ্রে আনসারের জ্যাকেটে এমন তরুণ-তরুণীদের দেখা গেছে, তার অন্যতম ঢাকা সিটি কলেজ কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কেন্দ্রে ভোট দেন। এই কেন্দ্রে মাসুমের সঙ্গে বাঙলা কলেজের আরেক এইচএসসি পরীক্ষার্থী শরিফুল খানও দায়িত্ব পালন করে। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনী দায়িত্ব বণ্টনের খাতায় তাদের অন্য নাম লেখা ছিল। অর্থাৎ তারা ছদ্মনামে দায়িত্ব পালন করেছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজধানীর লালবাগ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে আনসারের জ্যাকেট পরে দায়িত্ব পালন করে তরুণেরা। গত মঙ্গলবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
সিটি কলেজ কেন্দ্রে আনসারের জ্যাকেট পরা ইব্রাহিম নামের এক যুবক সাংবাদিকদের জানান, তিনি রায়েরবাজারে দোকানদারি করেন। সাথি নামের রায়েরবাজারের এক আওয়ামী লীগ নেত্রী তাঁকে এ কাজ পাইয়ে দেন। আর কেন্দ্রে নিয়ে আসেন রায়েরবাজারের ছাত্রলীগের তিন কর্মী মাসুম, শরিফুল জাহান ও রুহুল হিমু।
কাঁঠালবাগানের খান হাসান আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসির শিক্ষার্থী আশরাফুল হোসাইনসহ চার-পাঁচজন, খিলগাঁও আলী আহম্মদ স্কুলে একটি ব্যাংকের মতিঝিল শাখার ম্যাসেঞ্জার হাসানুর রহমানসহ সাত-আটজন, ধানমন্ডির সাউথ ব্রিজ কেন্দ্রে কলাবাগানের একটি হোটেলের কর্মচারী রাজ্জাকসহ তিন-চারজন, ধানমন্ডির আয়েশা একাডেমি কেন্দ্রে ভাঙারি ব্যবসায়ী মাইনুদ্দিনসহ চার-পাঁচজনকে আনসার ও ভিডিপির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্র, ভিকারুননিসা নূন স্কুল কেন্দ্র, সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র, মায়াকানন স্কুল, শেওড়াপাড়া আশরাফ আলী হাইস্কুলসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে কম বয়সী তরুণ-তরুণী ও কিশোরদের আনসারের জ্যাকেট গায়ে দায়িত্বে দেখা গেছে।
আনসার ও ভিডিপির একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য যে প্রক্রিয়ায় আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের নির্বাচিত করা হয় তা স্বচ্ছ নয়। এ প্রক্রিয়ায় কোনো রকম বাছ-বিচার না করে, স্থানীয় আনসার কমান্ডাররা তাঁদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দেন। দায়িত্ব পালনের জন্য দৈনিক ৩২০ টাকা করে চার দিনে পাবেন ১২৮০ টাকা ভাতা, সঙ্গে ১০০ টাকা যাতায়াত ভাতা এবং শুকনো খাবারের জন্য ২৫০ টাকা। সব মিলিয়ে জনপ্রতি ১৬৩০ টাকা পাবেন।
আনসারের সূত্র জানায়, এবার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ২৭ হাজার ৭৪৮ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এঁদের মধ্যে ২ হাজার ৮০৪ জন নিয়মিত এবং ৩ হাজার ৯৩৬ জন অস্থায়ী আনসার (মাস্টার রোলে কাজ করেন) সদস্য। এঁরা অস্ত্র হাতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি সব সদস্য লাঠি হাতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। লাঠি হাতে থাকা ব্যক্তিরা আনসার বাহিনীর কেউ নন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আসেন। নির্বাচনের সময় মাত্র চার দিনের জন্য তাঁদের নিয়োগ করা হয়। আনসার ও ভিডিপির ওয়ার্ড নেতারাই এঁদের তালিকা করেন। এরপর রাজধানীর ২২টি থানা কর্মকর্তার হাত হয়ে ওই তালিকা আসে জেলা আনসার কমান্ড্যান্টের কাছে। তিনি তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তরে পাঠান।
যাচাই-বাছাই না করে এভাবে নিয়োগ পাওয়া লোকজন যদি বড় ধরনের নাশকতায় জড়িয়ে পড়ে তার দায়িত্ব কে নেবে—জানতে চাইলে আনসারের ঢাকা জেলা কমান্ড্যান্ট নুরুল হাসান ফরিদী প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের তিন দিন আগে সবার চূড়ান্ত তালিকা পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। পুলিশ তা যাচাই করে দেখার পর দায়িত্ব পালন করার অনুমতি দেওয়া হয়।
তালিকা পাওয়ার পর এসব লোকের ব্যাপারে আদৌ কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয় কি না, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে অন্য সব বাহিনীর মতো আনসারও দায়িত্ব পালন করে। তারা কাদের দিয়ে কাজ করাবে সেটা তাদেরই ব্যাপার। আনসারের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া পুলিশের কাজ নয়। পুলিশ সে কাজ করেও না। তা ছাড়া তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার লোকের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়াও সম্ভব নয়। আনসার যাদের তালিকাভুক্ত করবে তাদের দায়িত্ব আনসার বাহিনীরই।

No comments

Powered by Blogger.