যে ৬ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে হিলারিকে

কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির উদারপন্থিরা তার কাছ থেকে ছয়টি বড় প্রশ্নের উত্তর চান। উদারপন্থি মার্কিনিদের সমর্থন আদায় করতে হলে এ ছয়টি প্রশ্নের দ্রুত জবাব দেয়া হিলারির জন্য আবশ্যক। এক বিশ্লেষণে এমনটিই লিখেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।
১. অভিবাসন সংস্কার: যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভের পথ কি পরিষ্কার করবেন হিলারি? আইওয়াতে তার প্রথম ধাপের প্রচারণায় হিলারি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ব্যাপক হারে অভিবাসননীতিতে সংস্কার আনার পক্ষে ছিলেন তিনি। তবে অতীত বলছে ভিন্ন কথা। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে ৭০০ মাইল দৈর্ঘ্যের কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন হিলারি। নিজের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি অনথিভুক্ত অভিবাসীদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স বরাদ্দের বিরোধিতা করেছিলেন। পরে অবশ্য ওই অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন তিনি। লাখো অভিবাসীকে ফেরত পাঠানো ঠেকাতে   
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত মেয়াদে নির্বাহী আদেশ দিয়েছিলেন। সেটির আবার পক্ষে অবস্থান ছিল হিলারির। প্রায়ই নিজের অবস্থান বদলের জন্য সমালোচিত হয়েছেন তিনি। তার এমন পরিবর্তনশীল অবস্থানের কারণে এ প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠছে, তিনি কি অভিবাসীদের নাগরিকত্ব লাভের পথের পক্ষে লড়াই করবেন? প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অনথিভুক্ত অভিবাসী ও বিপুল পরিমাণ লাতিন এ উত্তরের অপেক্ষায় আছেন। রিপাবলিকানদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল প্রার্থী জেব বুশও এদের সমর্থনপ্রত্যাশী।
২. পাইপলাইন সম্প্রসারণ: কানাডার আলবার্টা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার একটি পাইপলাইনকে সংযুক্ত করতে ১১৭৯ মাইলের নতুন একটি পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে চলছে ব্যাপক বিতর্ক। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এ পাইপলাইন নির্মিত হলে, ময়লা তেল নিঃসরণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে। ফলে বাড়বে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ঝুঁকিও। অন্যদিকে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রিপাবলিকান শিবির বলছে, এ পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্পে সৃষ্টি হবে নতুন চাকরি। গত মাসে এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে চুপ করে আছেন হিলারি। ২০১০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ওই প্রকল্পে সমর্থন দিতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। একেবারে সামপ্রতিককালে তিনি এ ধরনের একটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। রিপাবলিকানরা এ প্রকল্প নিয়ে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রিপাবলিকানরা এ প্রকল্প নতুন করে এগিয়ে নিতে চাইলে হিলারি কি বাধা দেবেন?
৩. কালো টাকা: আইওয়াতে নিজের প্রচারণা সূচনাকালে হিলারি বলেছিলেন, তার চারটি বড় অগ্রাধিকারের একটি হচ্ছে অকেজো রাজনৈতিক পদ্ধতির পরিবর্তন আনা। একই সঙ্গে হিসাববিহীন অর্থায়ন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা। তিনি সম্ভবত সাংবিধানিক সংশোধনের কথা বিবেচনায় নিতে পারেন। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের একটি রুলিং অকার্যকর করাই হবে এর লক্ষ্য। তবে সংবিধান সংশোধন করতে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে তিন-চতুর্থাংশ সমর্থন ও ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৩৮টির সমর্থন লাগবে। যেটি অত্যন্ত কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনিই ছিলেন এ ধরনের চর্চার ফলভোগী। তার বিভিন্ন প্রচারণার জন্য ব্যাপক অর্থ প্রয়োজন হবে। সেসব বিবেচনায় নিয়ে, হিলারি কি নির্বাচনী তহবিলে কালো টাকা অর্থায়নের বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে লড়বেন? এবং তিনি কি ওয়ালস্ট্রিট থেকে অর্থ নেবেন?
৪. ওয়ালস্ট্রিট: ওয়ালস্ট্রিট পছন্দ করে হিলারিকে। পলিটিকো ম্যাগাজিন যেমনটি লিখেছে, বড় ব্যাংকগুলোর কর্তাব্যক্তিরা তাকে বাস্তববাদী ও বন্ধুপরায়ণ ভাবেন। এর কারণেই হয়তো প্রতিবার তাদের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে এলে হিলারি ক্লিনটনকে ২ লাখ ডলার দিতে রাজি হয় পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া ক্লিনটন পরিবারের বিভিন্ন প্রচারণায় মোটা অঙ্কের অর্থও বরাদ্দ দেয় ওয়ালস্ট্রিটের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। মার্কিন সিনেটর থাকার সময় হিলারির শীর্ষ ১০ দাতার মধ্যে ৫টিই ছিল ওয়ালস্ট্রিটের ব্যাংক। অন্যদিকে ডেমোক্রেট দলে এলিজাবেথ ওয়ারেন ক্রমেই প্রগতিশীল অংশকে মুগ্ধ করেই যাচ্ছেন। যদিও তিনি ডেমোক্রেট দল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী নন। ওয়ারেন সরকারকে আকাশচুম্বী নির্বাহী ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যাংক নিয়ন্ত্রকদের ভীরুতার নিন্দা জানাচ্ছেন। এর পরই হিলারিও নিজের ওয়ালস্ট্রিট প্রীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। অথচ তার এ ব্যাপারে কোন সঠিক নীতির দেখা নেই। সমপ্রতি টাইম ম্যাগাজিনে এলিজাবেথ ওয়ারেনের স্তুতি গেয়ে একটি লেখা লিখেছেন হিলারি। এ ছাড়া সাবেক এক ব্যাংক নিয়ন্ত্রককে নিজের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন হিলারি। ওই ব্যাংক নিয়ন্ত্রক ওয়ালস্ট্রিটের জন্য স্বস্তিকর ছিলেন না। প্রশ্ন হলো, ওয়ালস্ট্রিটের দিক থেকে হিলারির এ নতুন মুখ ফিরিয়ে নেয়াটা কত দিন স্থায়ী হবে? এটি কি ওয়ালস্ট্রিটের একটি সত্যিকার সংস্কারের দিকে রূপ নেবে?
৫. সমকামী অধিকার: সমকামী, উভকামী ও হিজড়াদের (এলজিবিটি) অধিকারের ক্ষেত্রে তিনি আসলে কতটা সচেতন? ক্লিনটনের শিবির দ্বার্থহীনভাবে বলেছে, হিলারি ক্লিনটন সমলিঙ্গের বিয়েকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে গণ্য করেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি আগাম সমালোচনা এড়াতে সক্ষম হয়েছেন, যা ডেমোক্রেটদের প্রাথমিক লড়াইয়ে তার জন্য সমস্যা হতে পারতো। ক্লিনটনের এ ঘোষণা ও তার প্রচারাভিযানে বহু সমকামী জুটির ছবি আসায় এলজিবিটি সম্প্রদায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কেননা, হিলারিই গত বছর ঘোষণা দিয়েছিলেন, সমলিঙ্গের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই উত্তম। তবে এদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এলজিবিটি সমপ্রদায়ের অধিকার রক্ষায় কতটা লড়াই করবেন হিলারি? তার প্রশাসন কি সমকামীবিরোধী ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ আইনটি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সর্বোচ্চ লড়াই করবে? তিনি কি মার্কিন সেনাবাহিনীতে হিজড়াদের নিয়োগে বাধা দূর করবেন? এ বিষয়টি এখনও বেশ স্পর্শকাতর। তার স্বামী বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই সামরিক বাহিনীতে সমকামীদের নিয়োগের বিষয়ে ‘ডোন্ট আস্ক, ডোন্ট টেল’ নীতি অনুমোদন করেছিলেন। এ নীতি অনেকটাই অর্থহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
৬. প্রশান্ত-মহাসাগরীয় আংশীদারিত্ব: রিপাবলিকানদের সঙ্গে বিরল ঐকমত্য গড়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা ১১টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চান। ১৯৯৪ সালের উত্তর আমেরিকানমুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পর এটিই হবে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী বাণিজ্য চুক্তি। ১৯৯৪ সালের ওই চুক্তিটি করেছিলেন বিল ক্লিনটন। তবে এএফএল-সিআইওসহ বেশ কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে, তারা এ চুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। অনেক জ্যেষ্ঠ ডেমোক্রেট নেতাও বলছেন, এ চুক্তি আমেরিকার চাকরি ও বেতন-ভাতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। হিলারি ক্লিনটন এ ইস্যুতে বেশ বড় ধরনের বেকায়দায় পড়েছেন। বারাক ওবামা ও বড় ধরনের ব্যবসাকে সমর্থন দেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা তার রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তার সমর্থক শ্রমিক ইউনিয়ন ও প্রগতিশীলদের মনও তার রক্ষা করতে হবে। প্রশ্ন হলো, হিলারি কি বাণিজ্য চুক্তিবিরোধী অবস্থান নেবেন, ঠিক যেমনটা তার গতবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়েছিলেন? নাকি তিনি তিন বছর আগে করা তার মন্তব্যেই অটুট থাকবেন? সে সময় হিলারি বলেছিলেন, বাণিজ্য চুক্তিসমূহের মাপকাঠিতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্ব চুক্তিটি ‘সোনালি’ পর্যায়ের।
কোন দিকে যাবেন, হিলারি?

No comments

Powered by Blogger.