ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ by মুসতাক আহমদ ও মাহমুদুল হাসান নয়ন

বেপরোয়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ কি ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে? এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক দিনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠটির এক শ্রেণীর নেতাকর্মী খুনাখুনির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন। আবার প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া এসব সংঘাত-সহিসংতায় ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, যা কোনো বৈধ অস্ত্রও নয়। আর এসব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা আরও উদ্বেগজনক। প্রাপ্ত তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভর্তি বাণিজ্যের মতো উল্লেখযোগ্য বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সারা দেশে এখন অন্য দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ নয়। নিজেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে প্রায়ই সংঘাত-সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে। অপরদিকে ছাত্রলীগকে শিক্ষক লাঞ্ছিত করাসহ মেয়েদের যৌন হয়রানির মতো ঘৃণিত অপরাধের দায় নিতে হচ্ছে। সম্প্রতি এ রকম কিছু নিন্দনীয় ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত জড়িত কয়েকজনকে বহিষ্কারও করা হয়। তারা মনে করেন, এতে করে ছাত্রলীগ নামধারী এসব দুর্বৃত্তকে শক্ত হাতে শাস্তি দিতে না পারলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনটি। এতে করে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সম্পর্কে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে।
গত ১৬ দিনের এক হিসাবে দেখা গেছে, কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী নিজেদের মধ্যে পাঁচটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে তিনজনের। আহত হয়েছেন ৪৯ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে রংপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। অপরদিকে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে বুয়েট শিক্ষকরা ধর্মঘটে আছেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও কার্যত অচল রয়েছে। আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি খুলেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশে (গোল চিহ্নত)
পয়লা বৈশাখে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা
নিশাত ইমতিয়াজ বিজয়।
ছাত্রলীগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বিষয়ে যুগান্তরে প্রকাশিত গত ৬ বছরের বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ সময়ে খুন হন ৪২ জন। এর মধ্যে গত বছরই খুন হন ৬ জন। আর প্রতিটি খুনের ঘটনার পেছনে হয় চাঁদাবাজি, না হয় টেন্ডার নিয়ে বিরোধ অথবা ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব ভূমিকা রেখেছে। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘর্ষে মাহমুদুল হাসান ও মো. জাকারিয়া নামে দুই ছাত্র নিহত হন। যারা সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে হল দখলের বিষয়টি উঠে এলেও নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উন্নয়ন ও কেনাকাটার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা ও ভর্তি বাণিজ্য।
এর আগে ১১ এপ্রিল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কর্মী সম্মেলনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জেলা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক ছাত্রলীগ নেতা খুন হন। সেখানে প্রকাশ্য কারণ ছিল কমিটি দখল। অর্থাৎ যারা কমিটিতে থাকবে তারা সব কিছুর হিস্যা পাবে। অগত্যা কমিটি দখলের জন্য রক্তপাত ছিল অনিবার্য।
এদিকে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনা বড় কেলেংকারির জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে এখন দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
গোয়েন্দা সূত্র ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বর্তমান এবং সাবেক নেতাদের হস্তক্ষেপে সৃষ্ট গ্র“পিং, ভালো পদ পেতে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া, দলে ‘চেইন অব কমান্ড’ না থাকা, শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব, অনিয়মিত কাউন্সিল ইত্যাদি এ ধরনের সংঘাত সহিসংতার প্রধান কারণ। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, সবকিছুর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে অবৈধ অর্থ উপার্জনের নেশা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের কয়েকজন ত্যাগী নেতা যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ এখন চাকরিতে, কিছু নেতা দ্রুত বড় লোক হতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদারি লাইসেন্স। কেউ আবার টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসার মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কার্যত দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের অনেক নেতার কাছে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পরিবর্তে সংগঠনকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জনই প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষ।
এদিকে উত্থাপিত এসব অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, সংগঠনে চেইন অব কমান্ডের কোনো সমস্যা নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনা দৃষ্টান্ত হতে পারে না। তবে যখনই কোনো ঘটনা ঘটেছে তখনই আমরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। এমনকি পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। সংগঠনের নামে যারা নানা অঘটন ঘটাচ্ছে তারা আসলে ছাত্রলীগের কেউ নয়। তিনি বলেন, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে তা শুধুই অপপ্রচার। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনাটি আমরা তদন্ত করছি। দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ফৌজদারি অপরাধে কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগে নিজেদের মধ্যে এ ধরনের অব্যাহত সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডসহ অনেক সিনিয়র নেতাও ক্ষুব্ধ। যে কারণে গত বছর তিন দফায় প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রলীগের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এর আগে ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র পদ থেকে পদত্যাগও করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধিকবার বলেছেন ‘ছাত্রলীগে শিবির ঢুকেছে’।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একের পর এক সংগঠনের এক শ্রেণীর নেতাকর্মীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে প্রশ্রয় দেয়ার ঘটনা। বিগত ৬ বছরে ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছাড়া আর কোনো ঘটনায় কাউকে তেমন একটা বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কোনো নেতা বা কর্মী অপরাধে লিপ্ত হলে সংগঠন তাকে সর্বোচ্চ ‘বহিষ্কারে’র সাজা দিয়ে থাকে। বিগত ৬ বছরে প্রায় ১২শ’ নেতাকর্মী এভাবে বহিষ্কারের শাস্তি পেলেও তার বেশিরভাগই লোক দেখানো বলে জানা গেছে। রাজধানীর ঢাকা কলেজে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে এক ছাত্র নিহতের ঘটনায় কমিটি স্থগিত করলেও পরবর্তী সময় সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লব ও সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান সুইমকে কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। ইডেন কলেজের কমিটি স্থগিত থাকলেও সভাপতি নিপা ও সাধারণ সম্পাদক অর্চিকে বেশকিছু কর্মসূচিতে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে ৯ সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায় সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির নেতারা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিফ আহমেদ নামে একজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলেও তিনি এখন বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সেই মূল নিয়ন্ত্রক। ভাসানী হলে সম্প্রতি এক সংঘর্ষের ঘটনায় নূরনবী ও অনিন্দ বাড়ৈকে আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলেও তারা ক্যাম্পাসে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তম কুমার নামে একজন কেন্দ্রীয় নেতা সেখানকার ছাত্রলীগের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। অথচ তাকে বহু আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন থেকে অর্ধশতাধিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হলেও তারাই এখনও ক্যাম্পাসের মূল ত্রাস। এদের মধ্যে জালাল, রুপম বিশ্বাস, তুষার, আরাফাত প্রমুখ হল ও ক্যাম্পাসে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তুহিন-জাহাঙ্গীর কমিটির সঙ্গে আবুজর গিফারী গাফফার এবং আলি মুর্তজা খসরু গ্রুপের সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়। কিন্তু এ সংঘর্ষের হোতা আবুজার গিফারি গাফফার বহিষ্কার হলেও পরবর্তী সময় তাকে সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।
(রিপোর্টটি তৈরিতে যুগান্তরের রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেট শাহজালাল ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা সহযোগিতা করেন)

No comments

Powered by Blogger.