ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি টিকবে তো?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ছবি: এএফপি
পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির (জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি) মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে একটি চূড়ান্ত চুক্তি হবে। কোন পক্ষকে কী করতে হবে, এর বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে চুক্তিতে। সমঝোতা অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে।
চুক্তি তো হলো, প্রশ্নটা হচ্ছে-এ চুক্তি আসলে কতটা টেকসই হবে?
ছয় পরাশক্তির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দেশ ইরানের সমঝোতার ঘটনাটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এটাকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে অভিহিত করছেন। এ নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে।
পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির চুক্তিকে ‘এক জীবনে একটাই সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে চুক্তিটির ওপর ভোটাভুটির দাবি তুলেছেন তাঁর বিরোধী রিপাবলিকানরা। এটিকে ‘খারাপ চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এত কিছুর পর এ চুক্তির ফলে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন হবে, তা এখন দেখার বিষয়। কারণ ইরানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার নিয়ে বিপদের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে এত দিন প্রচার করেছে ওয়াশিংটন। সেই ইরানের সঙ্গেই পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে সমঝোতার পথে এক ধাপ এগোল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা অনেকে মনে করছেন, সমঝোতার বিষয়টি এগিয়ে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এএফপির বিশ্লেষণে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় আছেন কয়েকটি মাস। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি অন্তত একটি বিরোধের সমাধানে আগ্রহী। তা হলো ইরানের সঙ্গে পুনরায় মার্কিন সম্পর্ক স্থাপন। তিনি যদি তা করতে পারেন, তবে এটা হবে বিদায় নেওয়ার আগে তাঁর একটি বড় কাজ।
আলোচনার পর সুইজারল্যান্ডের লুজানে হওয়া চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন পথ খুলে গেল। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এ চুক্তির ফলে ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে থাকা মার্কিন শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতে পুনঃস্থাপনের আশা ক্ষীণ। কার্নেগি সেন্টারের ভিজিটিং ফেলো জোসেফ বাহুত বলেন, ‘বারাক ওবামা হয়তো ভাবছেন অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের ফলে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে বোধ হয় নতুন দরজা খুলল। এটা ওবামা প্রশাসনেরও কল্পনা। তবে তিনি (ওবামা) জানেন, এটা কখনোই ঘটবে না। কারণ ইরানের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের স্বরূপটি এত দিন ধরে যেভাবে চলে এসেছে তা থেকে খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।’ ইরান এই চুক্তি গ্রহণ করবে, কিন্তু সবকিছু তারা আগের মতো চালাবে বলে মনে করেন জোফেস বাহুত।
১৯৫৩ সালের এক অভ্যুত্থানে ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে হটিয়ে শাহের শাসন শুরু হয়। এর পেছনে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জড়িত ছিল। এর পর থেকে তেহরান ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনিপন্থীরা মার্কিনপন্থী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সরকারকে হটিয়ে ইরানের ক্ষমতায় বসে। এরপর থেকে এই দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক কয়েক দশক ধরে চলছে। ইরানের নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মহা শয়তান’ রাষ্ট্র বলে অভিযুক্ত করে থাকে। অপরদিকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে ওয়াশিংটন তেহরানকে ‘মন্দ অক্ষ’ বলে থাকেন।
এই সমঝোতাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের’ ভিত্তিতেই ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা হবে। তবে তিনি ইরানকে সতর্কও করে দিয়ে বলেছেন, ‘এই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেও ইরান ও মার্কিনের দুই দেশের মধ্যেকার গভীর বিভাজন ও অবিশ্বাস শেষ হবে না।’ ইরানকে ‘সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক’ আখ্যা দিয়ে ওবামা আরও বলেন, এবার কোন ভুল করা চলবে না। আমরা ইরানের কাজের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছি।
বড় ঝুঁকি
২০১১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফের মধ্যে সাক্ষাতের পর দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলা শুরু। গত দেড় বছর ধরে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির মধ্যে আলোচনার ফলে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা দুয়ার খুলে একটি সমঝোতা হলো। তবে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুই পক্ষই বড় ঝুঁকি ও সংশয়ের মধ্যে আছে। এ চুক্তির ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির রাশ টেনে ধরটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা ‘জয়’ বলা যেতে পারে। এ চুক্তির ফলে ইরানের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশটির অর্থনীতি বের হয়ে আসবে।
২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ফোন করেছিলেন বারাক ওবামা। গত তিন দশকের মধ্যে এই দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এই ফোনালাপের ঘটনাটি ঐতিহাসিক। গত বছরের অক্টোবরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনিকে একটি চিঠি দেন। গত মাসে ইরান পার্সিয়ান নতুন বছর উদ্‌যাপন করে। এ সময় ‘ঐতিহাসিক’ সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ফার্সি ভাষায় এক ভিডিও বার্তায় বারাক ওবামা ইরানের প্রতি ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ শুরুর আহ্বান জানান। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পর বারাক আবার সতর্ক বলে জানিয়েছেন মার্কিন চিন্তন প্রতিষ্ঠান ব্রুকিং ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো সুজানে মেলোনি। তিনি এক ব্লগে লিখেছেন, ‘ইরানের সঙ্গে কূটনীতির ক্ষেত্রে ওবামা বাজি ধরেছে। ওবামা প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের নীতির ক্ষেত্রে চুক্তির ব্যাপারে আগে একগুঁয়েই ছিল।’
সহযোগিতা হবে কৌশলী
গত মার্চে ৪৭ জন রিপাবলিকান সিনেটর এক খোলা চিঠিতে দাবি করেন, কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চুক্তি হলে তা হবে কেবল বারাক ওবামা ও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির মধ্যে একটি সমঝোতা মাত্র। এর জবাব দিতে গিয়ে তাঁদের রীতিমতো একহাত নিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। এখন সম্পর্ক এগিয়ে নিতে দুই দেশকে কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে। এ ব্যাপারে মার্কিন চিন্তন প্রতিষ্ঠান র‍্যান্ড করপোরেশনের আন্তর্জাতিক নীতি পর্যবেক্ষক আলী রেজা নাদের এএফপিকে বলেন, ভবিষ্যতে ওয়াশিংটন ও তেহরানের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকুক ইরানের প্রভাবশালীরা এটা চায়, আমি তা বিশ্বাস করি না। সম্ভবত রুহানি ও তার সরকার ভালো কূটনৈতিক সম্পর্কই চায় কিন্তু দেশটির সর্বোচ্চ নেতা এবং তার সমর্থকেরা এর বিরুদ্ধে।’
পারমাণবিক সমঝোতার সময় ইরাক ও সিরিয়ার সংগঠিত আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই নিয়েও আলোচনা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে জন কেরি ‘পারস্পরিক স্বার্থে’ আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরানের সহযোগিতা চান। আফগানিস্তানের তালেবান ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি বলে মনে করেন তিনি। এত কিছুর পরও আলী রেজা নাদের মনে করেন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীই থেকে যাবে। তাঁর মতে, ‘ইরানের ভেতর বড় কোনো পরিবর্তন না এলে দুদেশ একে অপরের প্রতিপক্ষই থাকবে।’

No comments

Powered by Blogger.