নীরোর বাঁশি ও প্রক্টর by কাজল ঘোষ

রোম যখন পুড়ছে নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে। টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেয়েদের কাপড় খামচে ধরেছে একদল নরপশু, তখন সব শুনেও প্রক্টর কম্পিউটারে দাবা খেলছেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লিটন নন্দী প্রক্টরকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। প্রক্টর শুধু দেখি দেখছি করেই সময় নষ্ট করেছেন। ঘটনাস্থলের অদূরে দুজন পুলিশ সদস্য দায়িত্বরত ছিলেন। তাদের জানানো হলে তারাও ছুটে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ বখাটেকে ধরে পুলিশে দিলেও তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কোন বিবেকের তাড়নায় পুলিশ তাদের ছেড়ে দিল? কি বিচিত্র দেশ। সন্তানের চোখের সামনেই মাকে বিবস্ত্র করছে প্রকাশ্যে আর পার্কের ভেতরে হাজারো মানুষ তা অবলোকন করছে। স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে টানাহেঁচড়া করা হলো। একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক নারীদের ওপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর একজন লিটন নন্দী প্রতিবাদ করায় তার হাত ভেঙে দেয়া হলো। প্রশ্ন জাগে, প্রক্টর কিংবা দায়িত্বরত পুলিশের অবহেলার কোন কৈফিয়ত এখনও তলব করা হয়নি কেন? যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের এখনও চিহ্নিত করা হয়নি? যে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল পুলিশ কেন তাদের ছেড়ে দিল? তাহলে কি এটা বলা যায়, পুলিশ বা প্রক্টর সবাই কোন না কোন ভাবে এই ঘটনাটি নীরবে মিলিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। লিটন নন্দী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না। আমি আমার পাঞ্জাবি খুলে এক নারীকে দিয়েছিলাম। আরেকটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ওই যুবকেরা ভিড়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে। ছাত্র ইউনিয়নের ক’জন কর্মী এগিয়ে না গেলে বখাটেদের অসভ্যতার মাত্রা হয়তো আর বহুদূর গড়াতে পারতো। কারণ, পুলিশ বরাবরের মতো কিছু না দেখেও দায়িত্বে শিথিলতার পরিচয় দিয়েছে। কিছুদিন আগেই ফেব্রুয়ারির বই মেলা থেকে ফেরার পথে একই স্থানে প্রকাশ্যে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। অদূরে পুলিশ থাকলেও এগিয়ে আসেনি। হত্যাকারীরা নিরাপদে পালিয়েছে। পরে পুলিশের দেয়া প্রতিবেদনে কোন গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বর্ষবরণ ঘিরে এতো সিসিটিভি আর নানান স্তরের নিরাপত্তা বলয় উপেক্ষা করে বখাটেদের থাবা নিরাপদে তাদের কু-কর্ম সারতে পেরেছে। যারা সিসিটিভি ফুটেজ মনিটরিং করছিলেন তারাই বা কি দায়িত্ব পালন করলেন?
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পাশে (গোল চিহ্নত)
পয়লা বৈশাখে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা
নিশাত ইমতিয়াজ বিজয়।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাপ্তাহিক সম্পদাক গোলাম মোর্তোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গত কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একক নিয়ন্ত্রক ছাত্রলীগ, সঙ্গে পুলিশ নিয়ে। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন নেই। বাম ছাত্র সংগঠন আছে, শক্তির বিচারে ছাত্রলীগের তুলনায় তারা নগণ্য। তারা ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী  নয়। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নীতি-আদর্শের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং করে। সংখ্যা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের সমকক্ষ বা আর এক ধাপ এগিয়ে ছাত্রদল। ছাত্রলীগ এবং পুলিশের কারণে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারে না। ফলে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র রাজত্ব বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্রতিদ্বন্দ্বী না পেয়ে মাঝেমধ্যে নিজেরা নিজেরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, দু-একটি হত্যাকাণ্ডও ঘটায়। বর্ষবরণের দিনে মেয়েদের লাঞ্ছিত করার এই ঘটনায় বাধা দিতে গিয়ে হাত ভেঙেছে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীর। নিজের গায়ের পাঞ্জাবি খুলে একটি মেয়ের সম্মান তিনি বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। প্রতিবাদ, মিছিল- মিটিংও করেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। রাজত্বের মালিক ছাত্রলীগ কোথায়?
বর্ষবরণে রমনা বটমূলে বোমা হামলার পর থেকে প্রতিবছর এ দিনটি এক উদ্বেগ নিয়ে কাটাই। কখন কি ঘটে। ঘটনার একযুগ পরও এখনও বোমা হামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। ঘৃণ্য সে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। ১৯৯৯ সালের থার্টিফার্স্ট নাইটে টিএসসিতে একদল বখাটে বাঁধনকে টেনেহিঁচড়ে বিবস্ত্র করেছিল। সেই ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দেশজুড়ে সে ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল। যারা চারপাশ ঘিরে বাঁধনকে নিয়ে উল্লাস করেছে তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছিল। বাঁধন একটি মামলা করলে দশ বছর পর সেই মামলার আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছিল। বিচার তো বাঁধন পাননি উল্টো দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাদী সাক্ষী না দেয়ায় তা প্রমাণিত হয়নি। কথা থাকে, ছবিটিতে স্পষ্ট থাকার পরও অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় শাস্তি পায়নি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি সেদিন সেই ঘটনায় যুক্তদের দৃষ্টান্ত্তমূলক সাজা হলে আজ আর এ ধরনের ঘটনা হয়তো ঘটতো না।
আসুন, প্রতিবাদে শামিল হই। প্রতিরোধ গড়ে তুলি, যেন এ ধরনের ঘটনা আর একটিও না ঘটে।
লিখেছেন কাজল ঘোষ

No comments

Powered by Blogger.