যখন সাঈদ খোকনের অপেক্ষায় by মশিউল আলম

সাঈদ খোকনের জন্য বানানো প্যান্ডেলের
সামনে কর্মী–সমর্থকদের অপেক্ষা
আকাশভরা মেঘ। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে, বইছে হিমেল বাতাস। সেই বাতাসে দুলছে মুগদা থানার মানিকনগর বড় মসজিদ পুকুরপাড়ের গুটিকয় কড়ইগাছের ডালপালা। দুলছে রাস্তার দুই পাশে আড়াআড়ি করে টানানো চিকন দড়িগুলোতে ঝোলানো অজস্র পোস্টার। সেগুলো ইতিমধ্যে ভিজে চুপসে গেছে।
সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে দঁাড়িয়ে আছি একটা চায়ের দোকানে, যার মাথার ওপরে সামান্য ছাউনি আছে, ফলে বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে না। এই বড় মসজিদ পুকুরপাড় থেকেই শুরু হওয়ার কথা ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকনের ২৫ এপ্রিল শনিবারের নির্বাচনী জনসংযোগ। আগের সন্ধ্যায় ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’র প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানতে পেরেছিলাম, জনসংযোগ শুরু হবে সকাল সাড়ে নয়টায়। কিন্তু আজ সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে সাঈদ খোকনের ব্যক্তিগত সহকারী জনাব সুমনের পাঠানো মুঠোফোনের খুদে বার্তা থেকে জানতে পারলাম জনসংযোগ শুরু হবে বেলা ১১টায়, ঠিক এখান থেকেই।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বাকি আছে আর মাত্র তিন দিন। কিন্তু এই এলাকাটিতে, অন্তত এই বৃষ্টিভেজা শীতল সকালবেলা, কোনো নির্বাচনী উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশ ঢেকে পোস্টারগুলো যদি না ঝুলে থাকত, তাহলে হয়তো বোঝাই যেত না যে আর তিন দিন পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বড়সড় একটা ভোটযুদ্ধ। বৃষ্টির মধ্যে চুপ করে আছে পাড়াটি, মাঝেমধ্যে রিকশার টুং টাং আর হঠাৎ দু-একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর তেমন কোনো শব্দ নেই। নেই মিছিল-স্লোগানের শব্দ। ভোট চেয়ে মাইকিংও করছে না কেউ।
হাতে ঢের সময় আছে, তাই টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলাম। দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে কথা বলতে লাগলাম লোকজনের সঙ্গে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্নার সরঞ্জাম ও তৈজসপত্র ভাড়া দেয়—এমন একটা ‘ডেকোরেটর’ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বসে বসে গল্প করছেন কয়েকজন যুবক। তাঁদের নিজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘সিটি নির্বাচন তো এগিয়ে এল, তো এ ব্যাপারে আপনাদের ভাবনাচিন্তা কী?’
যুবকদের একজন, যিনিই সম্ভবত প্রতিষ্ঠানটির মালিক, বললেন, ‘ইলেকশনের আমেজ তো সে রকম নাই।’
‘কেন নাই বলে আপনার মনে হয়?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কী বলবেন তা হয়তো ভাবতে লাগলেন, তাঁর পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘এলাকা শান্ত আছে। খুবই শান্ত। মারামারি-গন্ডগোল নাই।’
কোন মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে জিততে পারেন—এ রকম কৌতূহল থেকে আমি বললাম, ‘হাওয়া কোন দিকে?’
উত্তরে একজন হেসে বললেন, ‘হাওয়া এই দিকেও আছে, ওই দিকেও আছে।’ কিন্তু তাঁর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে প্রথমজন বললেন, ‘না, হাওয়া আছে। যেমন ধরেন, এই এলাকায় আমরা কম বয়সীরা বিএনপি। কম বয়সী কাউরে পাইবেন না যে আওয়ামী লীগরে সাপোর্ট করে, কিন্তু মুরব্বিরা বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের সাপোর্টার।’
এবার আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে জিতবে কোন দলের প্রার্থী?’
প্রথমজন বললেন, ‘তা বলতে পারব না।’ দ্বিতীয়জন বললেন, ‘সেটা বোঝা যাবে ভোটের আগের রাতে।’ তৃতীয়জন বললেন, ‘যে-ই জিতুক, ভোটটা শান্তিমতন হইলেই হলো।’
অন্য এক দোকানে ঢুকলাম। মধ্যবয়সী দোকানিকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সিটি নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনার কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘এই ইলেকশনের আগে দরকার ছিল সংসদের ইলেকশন। ৫ জানুয়ারি যে ইলেকশন হইছে, সেটা কোনো ইলেকশনই হয় নাই। আমি তো ভোট দিতে যাই নাই।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
দোকানি বললেন, ‘কারণ সেই ইলেকশনে বিএনপি ছিল না। বিএনপি হলো দেশের দুই প্রধান দলের একটা। দেশের অর্ধেক লোক
যদি আওয়ামী লীগের সাপোর্টার হয়, তো বাকি অর্ধেক বিএনপির সাপোর্টার। বিএনপিরে বাদ দিয়া যে ইলেকশন, সেইটা কোনো ইলেকশনই না।’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বিএনপিকে ভোট দিতে চেয়েছিলেন বলেই কি সেই নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি?’
দোকানি বললেন, ‘তা তো বলা যাবে না। কথা হলো ইলেকশন হইতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে।’
আমি বললাম, ‘সিটি নির্বাচনে তো বিএনপি অংশ নিচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই এবার ভোট দিতে যাবেন? ’
‘হ্যাঁ, যাব,’ তাঁর উত্তর, ‘সিটি ইলেকশন হইব ৫ জানুয়ারির ইলেকশনের প্রতিবাদ। পাবলিক যে এই সরকারের সাথে নাই, তার প্রমাণ মিলে যাবে সিটি ইলেকশনের ফলাফলে।’
আমার মনে হলো, এ রকম কথা বোধ হয় এর আগেও কোথাও কোথাও, কারও কারও মুখে শুনে থাকব।
কিন্তু আরেক দোকানির বক্তব্য, ‘মানুষ বুইঝ্যা গেছে, এই সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষমতা বিএনপির নাই। এই সরকার আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকবে। তাই সিটি ইলেকশনে বিএনপির প্রার্থীরে ভোট দিয়া কোনো লাভ নাই। বিএনপির প্রার্থী মেয়র হলে কোনো কাজই করতে পারবে না, কারণ সরকার তারে সহযোগিতা দিবে না। এর আগে পাঁচটা সিটি ইলেকশনে বিএনপির প্রার্থীরা মেয়র হইছে, তারা কোনো কাজ করতে পারছে? উল্টা আরও সরকারের হয়রানিতে তাদের অবস্থা খারাপ। ঢাকার মেয়র যদি বিএনপি থিকা হয়, তাইলে ঢাকাবাসীর কপালে খারাবি আছে।’
হঠাৎ মনে পড়ল ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হকের কথা। তিনি এই বলে ভোটারদের প্রলুব্ধ করতে চাইছেন যে, সরকার-সমর্থিত প্রার্থী মেয়র হলে তিনি বেশি কাজ করতে পারবেন।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। তাঁর হাতে ২৫ এপ্রিলের প্রথম আলো। পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করলে তিনি ‘বিধি ভেঙে ভোট প্রার্থনা সাঈদ খোকনের’ শিরোনামের একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘আপনারা এই খবরটা ছাপায়া ভালো কাজ করছেন। দেখেন, খালেদা জিয়া বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামলেই তাঁর গাড়িবহরে হামলা হইতেছে, আর আওয়ামী লীগের সাঈদ খোকন বায়তুল মোকাররমের ইমামরে দিয়া দোয়া চাওয়াইতাছে। ইলেকশন কমিশন দেখলাম খালেদা জিয়ারে হুঁশিয়ার কইরা চিঠি দিতাছে। অথচ তারা সাঈদ খোকনের আচরণবিধি ভঙ্গ করা নিয়া কিছু বলতাছে না। এসব ঠিক না। অন্যায় যে হইতেছে, জনগণ তা দেখতেছে। দেইখেন, ইলেকশনের রেজাল্টের উপর এর প্রভাব পড়বে।’
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুকুরপাড়ের মোড়ে আগমন ঘটল পুলিশের ছয়জন সশস্ত্র সদস্যের। তারপর আসতে শুরু করল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের গাড়ি। ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমে গিয়ে রোদ উঠেছে, কড়ইগাছের ভেজা পাতাগুলো রোদে ঝিকমিক করে উঠল। পুলিশের আরও কয়েকজন সদস্য এলেন, গুনে দেখলাম মোট ১৩ জন। তাঁদের কারও হাতে শটগান, কারও হাতে রাইফেল, দু-একজনের কোমরে পিস্তল। তাঁদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁদের এখানে আসার কারণ কী। তিনি বললেন, ‘ডিউটি করতে হবে।’
‘সাঈদ খোকনের নির্বাচনী জনসংযোগে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী জনসংযোগে তো পুলিশ দেখিনি।’
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আমার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। বেলা ১১টা পার হয়ে গেল। সাঈদ খোকনের ‘পথসভা’র জন্য পথের পাশে তৈরি করা ছোট্ট একটা প্যান্ডেলের সামনে লোকজন জড়ো হতে লাগলেন। পুকুরের অন্য পাড়ের রাস্তার দিক থেকে মাইকে ভেসে এল একটা পুরুষ কণ্ঠ: ‘সাবের ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। ‘সাবের ভাইয়ের সালাম নিন, ইলিশ মাছে ভোট দিন’।
জানা গেল, সাঈদ খোকনের জনসংযোগ কর্মসূচির এই পর্যায়ে তাঁকে সমর্থন জানাতে এখানে আসবেন স্থানীয় সরকারদলীয় সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী। সোয়া ১১টার দিকে একটা ট্রাক এল, তাতে বাঁধা মাইকে বাজছে এক পুরুষ কণ্ঠ: ‘সম্মানিত এলাকাবাসী... আলহাজ সাঈদ খোকনকে ইলিশ মাছ মার্কায় ভোট দিন’।
দুপুর ১২টা পেরিয়ে গেল। সাঈদ খোকন এলেন না। ১২টা ১১ মিনিটে এল ভূমিকম্প, দুলে উঠল পায়ের তলার মাটি। পাশের পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, পুকুরের পানি দুলছে দোল খাওয়া কড়াইয়ের পানির মতো।
১২টা ২৫ মিনিটে ছোট্ট একটা মিছিল নিয়ে এলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। মিছিলের স্লোগান: ‘সাবের ভাইয়ের সালাম নিন, ইলিশ মাছ মার্কায় ভোট দিন’।
বেলা একটায়ও এলেন না সাঈদ খোকন। ঝমঝম করে নেমে এল বৃষ্টি। সেই তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকল তাঁর জন্য বানানো প্যান্ডেলখানা। আবার জানানো হলো, সাঈদ খোকন আসবেন বিকেল পাঁচটায়।
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.