১০ বছর পিছিয়ে গেল নেপাল

প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল নেপাল। এশিয়ার অন্যতম দরিদ্রতম এই রাষ্ট্র দু’দিনের তাণ্ডবে ১০ বছর পিছিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চার হাজার মানুষের প্রাণহানির পাশাপশি গ্রামাঞ্চল, রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, স্থাপনা ও প্রাচীন ঐতিহ্য মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। মার্কিন ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বলছে, নেপালের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১০০ থেকে ১০০০ কোটি মার্কিন ডলার। জিডিপির হিসেবে গড়ে ৩৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য ও গবেষণা সংস্থা আইএইচএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পে হিমালয়কন্যা নেপালের মোট অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ২০ শতাংশ। আইএইচএসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিশেষজ্ঞ রাজিব বিশ্বাস বলেন, নেপালের আবাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে নিুমানের।
ভূমিকম্পে তা নিদারুণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেল দেশটি। নেপাল পুনর্গঠনের দীর্ঘমেয়াদী খরচ ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এমন এক মুহূর্তে নেপাল এ আঘাত পেল, যখন ২০২২ সালের মধ্যে দেশটি অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে উত্তরণের চেষ্টা করছিল। ২০২০ সালের মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে অবকাঠামো খাতে বর্তমান বার্ষিক বাজেটের তুলনায় অন্তত ৪ গুণ ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে বলে জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষক নেপালের মুকেশ খানাল বলেন, ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১০০ বার ঝাঁকুনি খেয়েছে নেপাল। ছোট-বড় এসব ভূমিকম্পে স্থাপনা ও বাড়িঘরের যা ক্ষতি হয়েছে তাতে দেশটির অবকাঠামো খাত ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে।
কৃষি খাতে বিপর্যয়
১৯৯০ দশক পর্যন্ত নেপালের অর্থনীতি কৃষি খাত নির্ভর ছিল। বর্তমানে উৎপাদন ও সেবা খাতের ওপর বেঁচে আছে কাঠমান্ডু। জিডিপিতে সেবা খাত ৫২.২ শতাংশ অবদান রাখছে। সেবা খাতের মধ্যে রয়েছে পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বাণিজ্য, নির্মাণ শিল্প ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পণ্য কোম্পানি নেপালে তাদের উৎপাদন সামগ্রী নেপালে তৈরি করে। তা সত্ত্বেও কৃষি খাতের অবদান এখনও অনেক। দেশটির ২০০০ কোটি ডলার আকারের অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান ৩৩.৭ শতাংশ। ৭০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ খাতে জড়িত। এই ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষি খাত। দরিদ্রপীড়িত জনগণের মাধ্যমে এ খাতের আবেদন ভবিষ্যতে আর থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
লণ্ডভণ্ড পর্যটন শিল্প
পর্যটন শিল্পের উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল হিমালয় কোলঘেঁষা নেপাল। এই খাতটি দ্রুততম গতিতে উন্নয়নের দিকে হাঁটছিল। দেশটির ৭ শতাংশ জনগণের কর্মসংস্থান এ পর্যটন খাতে। ৫০ লাখ মানুষ এখান থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৮ লাখ বিদেশী পর্যটক নেপাল ভ্রমণ করেন। এভারেস্টে চড়তে প্রত্যেক বিদেশীকে দিতে হয় ১ লাখ ডলার। তবে তার কম অংশই পায় সরকার। আর পুরো দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু কাঠমান্ডু।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) তথ্যমতে, নেপালে ৭টি বিশ্ব ঐতিহ্য রয়েছে। যার ৪টিই ধ্বংস হয়েছে এবারের ভূমিকম্পে। ২৫ থেকে ২৭টি পর্বতঘেঁষা জেলা বিধ্বস্ত হয়েছে। নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি অধ্যাপক ও নেপাল স্টাডি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অলোক কে বোহারা বলেন, পর্যটন খাত নেপালের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত দুবছরে পর্যটকদের ভীড় বেড়েছে। কিন্তু ভূমিকম্প ও এভারেস্ট ধসের কারণে বিদেশি পর্যটক কমে যেতে পারে। যারা পরবর্তী বছরগুলোতে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তারা হয়ত আর যাবেন না।
এদিকে, রাজনৈতিকভাবেও নেপাল বিশৃংখল একটি দেশ। স্বাধীনতাকামী মাওবাদীদের সঙ্গে দশকব্যাপী সংঘর্ষ চলে আসছে। দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় ৬৯৪ মার্কিন ডলার, যা ভারতে ১৪৯৭ ও চীনে ৬৮০৭ মার্কিন ডলার। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় সর্বনিু। নেপালের মোট জিডিপির পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো একটি অঙ্গরাজ্যের চেয়ে অনেক নিচে। বিশ্ব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এমনকি কঙ্গো ও লাওসের নিচে ১৪৫ র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান করছে। এমন অনুন্নত দেশকে আরও ধ্বংসের অতল গহ্বরে ফেলে দিল সর্বনাশা ভূমিকম্প। কোয়ার্স ইন্ডিয়া।

No comments

Powered by Blogger.