নেপালে লাশ আর লাশ- নিহতের সংখ্যা ৪০০০ ছাড়িয়েছে

চারদিকে লাশ আর ধ্বংসস্তূপ। তার মাঝে উদ্ধারকর্মীরা খুঁজে ফিরছেন জীবিতদের। উল্টো বেরিয়ে আসছে লাশ। ছোট বাচ্চার লাশ। নারীর লাশ। স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরের লাশ। বয়স্ক মানুষের লাশ। এ দৃশ্য দেখে উদ্ধারকর্মীরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন। চোখ থেকে অশ্রু মুছে আবার ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছেন। এভাবেই লাশের সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ হাজারের বেশি। তবে এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক গ্রাম, জনপদ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানকার পরিস্থিতি জানা যায় নি। এমন অবস্থায় উদ্ধার অভিযানে নামানো হয়েছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পুরো দলকে।  ভূমিকম্প আর এর পরবর্তী একের পর এক কম্পনে পৃথিবীর বুকে অন্যতম নয়নাভিরাম দেশ নেপাল এখন এক বিরান ভূমি। ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। যাদের ছিল সুরম্য অট্টালিকা, তারা এখন নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন-রাত কাটাচ্ছেন। এখন নেপালে নেই বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন সংযোগ। নেই কোন দোকানপাট খোলা। বাড়িঘরগুলো যেন ভুতুড়ে আস্তানা। সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠছেন অনেকে। সব মিলিয়ে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্ধারকাজে সহযোগিতায় নেপালের উদ্দেশে রওনা হওয়া উদ্ধারকারী ও চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি দল এবং ত্রাণসামগ্রী এরই মধ্যে সেখানে পৌঁছেছে। রেডক্রসসহ বিভিন্ন দাতব্য সংগঠন সেখানে আগে থেকেই কাজ করছে। এদিকে রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করা হয়েছে এবং উদ্ধারকারী ও ত্রাণ বিতরণকারী দলের সদস্যরা আক্রান্ত অঞ্চলসমূহের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় এখনও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে না। রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে বিপর্যয়ের ভয়াবহতা চরমে। ভবন, মন্দির, উপাসনালয় সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত সমাহিত হয়েছে শ’ শ’ মানুষ। হাসপাতালগুলো আহতদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কমে আসছে ওষুধের মজুত। আশপাশের গ্রামগুলোতেও ভয়াবহ মাত্রার ক্ষয়ক্ষতির খবর এসেছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের নিকটবর্তী এলাকাগুলোর পরিস্থিতি এখনও স্পষ্ট নয়। কাঠমাণ্ডুতে সেভ দ্য চিলড্রেনের এক কর্মকর্তা দেবেন্দ্র সিং বলেন, প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর পর্যাপ্ত তথ্য এ মুহূর্তে নেই। রাস্তাঘাট আটকে আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাহত। তবে এমন ভাসা ভাসা খবর এসেছে যে ভূমিকম্পে বা ভূমিধসে গ্রামের পর গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ইউএসএইডের বিদেশী দুর্যোগ সহায়তা কার্যালয়ের পরিচালক জেরেমি কনিনডাইক বলেন, প্রাথমিক কিছু জরিপে আমরা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি এলাকাগুলো নিয়ে যা শুনছি তা হলো সেসব স্থানগুলো পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। দেবেন্দ্র সিং জানান, সেভ দ্য চিলড্রেন সহ অন্যান্য সহায়তা সংস্থাগুলো গতকাল প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে দল পাঠিয়েছে। নেপাল সরকার জানিয়েছে, সড়ক পথে যেসব স্থানে যাওয়া যাচ্ছে না সেসব স্থান হেলিকপ্টারযোগে উদ্ধারকারী দল পাঠানো হচ্ছে। কাঠমাণ্ডুর বিভিন্ন স্থানে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে তাঁবু খাটানো হয়েছে। সেখানে বৃষ্টি আর প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে কোনমতে রাতযাপন করছেন অধিবাসীরা। এদিকে ভারতে ৫৬ জন এবং চীনে আরও ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
চ্যালেঞ্জের মুখে ত্রাণ তৎপরতা
ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালানো মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, ওষুধপথ্যসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী অপ্রতুল হয়ে পড়ছে। কাঠমাণ্ডুর হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ডাক্তাররা সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। নেপালে সব রকমের সহায়তা পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরেশোরে চলছে। কিন্তু যেসব স্থানে সব থেকে বেশি সহায়তা প্রয়োজন সেখানে তা পৌঁছাচ্ছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।  রোববার বড় ধরনের আফটারশকের পর কিছু সহায়তা ফ্লাইট পৌঁছুতে বিলম্ব হয়। আর দেশটির পর্বতসংকুল ভূপ্রকৃতির কারণে রাজধানীর বাইরে অন্যত্র সহায়তা পৌঁছানো কঠিন এক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঠমাণ্ডুর প্রধান বিমানবন্দরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। কর্মকর্তারা একদিকে বহির্বিশ্ব থেকে আগত সহায়তা গ্রহণ করছেন। অপরদিকে নেপাল ছেড়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে আগত বহু সংখ্যক মানুষকে সামাল দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। এর পাশাপাশি বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পানি বা খাবারও সেখানে নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনের দেবেন্দ্র সিং আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানে কি পরিস্থিতি রয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
নেপালে আক্রান্ত বিদেশী নাগরিকদের পরিসংখ্যান
অস্ট্রেলিয়া: ৫৪৯ জন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নেপালে সফররত আছেন বলে তথ্য আছে। এদের মধ্যে ২০০ জন নিরাপদ আছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বাংলাদেশ: নেপালে অবস্থানরত বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৪ মেয়েদের ফুটবল দলের সদস্য সহ মোট ৫০ জন বাংলাদেশীকে সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। নেপালে বসবাসরত মোট বাংলাদেশীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বিবিসিকে জানিয়েছেন, সেখানে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশী নিরাপদে আছেন। এদের অনেকেই দেশে ফিরেছেন। অনেকের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগ হয়েছে বলে তিনি জানান।
চীন: বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী কাঠমাণ্ডুতে ৪ চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন।
কলম্বিয়া: ৭ জন নিখোঁজ।
ফ্রান্স: দেশটির কর্তৃপক্ষ ১০৯৮ জন নাগরিকের অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু এখনও ৬৭৪ জনের সঙ্গে তারা কোন যোগাযোগ করতে পারেননি।
ভারত: নেপালে ৫ ভারতীয় নিহত হয়েছেন।
ইউকে: কয়েক শ’ বৃটিশ নেপালে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায় নি।
যুক্তরাষ্ট্র: তিন মার্কিনি নিহত হয়েছেন।
এছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে এস্তোনিয়া ও জাপানের একজন করে নিহত হয়েছেন।  
আন্তর্জাতিক সহায়তা তৎপরতার সর্বশেষ তথ্য
ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তা দেয়ার জন্য ৮টি দল পাঠিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের চারটি দল ভারতের বিহার রাজ্য দিয়ে সীমান্ত পেরুনোর চেষ্টা করছে। এছাড়া একটি দল নয়াদিল্লি থেকে আর আরেকটি দল জাপান থেকে কাঠমাণ্ডুর উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। এদিকে শল্যচিকিৎসকদের ৮ সদস্যের একটি দল ব্রাসেলস থেকে আর অ্যামস্টারডাম থেকে আরেকটি দল মেডিক্যাল ও অন্যান্য ত্রাণ সহ নেপালের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন জানিয়েছে, তাদের সদস্যরা গোর্খা জেলায় পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছেন। শনিবারের ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেখানে। কিন্তু সেখানকার গ্রামগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে তারা জানিয়েছেন। দলটি বলেছে, গোর্খার প্রধান দুর্যোগ কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর দূরত্ব রাস্তা পরিষ্কার থাকলেও তিন দিনের হাঁটা পথ। যেসব গ্রামে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে সে স্থানগুলোতে অবিলম্বে প্রয়োজন অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা, খাবার, কম্বল এবং চিকিৎসা সেবা। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা অক্সফাম জানিয়েছে, তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া হাজারো ব্যক্তিকে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সরবরাহ করার জন্য এখন সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সংস্থাটির ধারণা অনুযায়ী আনুমানিক ৩০ হাজার মানুষ বর্তমানে সরকারি ১৬টি অস্থায়ী তাঁবু বা আশ্রয় ক্যাম্পে রয়েছেন। আবারও আফটারশক হতে পারে সে আশঙ্কায় তারা ঘরে ফিরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ জানিয়েছেন, দেশটি ৯ দলের একটি সংকট মোকাবিলা দল পাঠিয়েছেন। গতকাল তাদের কাঠমাণ্ডু পৌঁছানোর কথা। দলটি নেপালে আটকে পড়া অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নেপাল সরকারকে সহায়তা করবে। এদিকে, নিউজিল্যান্ড ৩৭ জন উদ্ধার ও অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞকে পাঠিয়েছে নেপালে। তাদেরও গতকাল দেশটিতে পৌঁছানোর কথা। এছাড়া, দেশটি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে ১০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে।
এভারেস্টে উদ্ধার তৎপরতা
গতকাল সকালে আবহাওয়া ভাল থাকায় মাউন্ট এভারেস্টের বেজ ক্যাম্প থেকে আহত পর্বতারোহীদের উদ্ধারে বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার সেখানে গেছে। এভারেস্টে ভূমিকম্পে সৃষ্ট ব্যাপক তুষারধসে গুগলের নির্বাহী কর্মকর্তা ড্যান ফ্রেডিনবার্গসহ ২২ জন নিহত ও বহু পর্বতারোহী আহত হন। কিন্তু এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এভারেস্ট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২০০ পর্বতারোহীকে। এনডিটিভি জানিয়েছে কমপক্ষে ৪০ জন ভারতীয় পবর্তারোধী এখনও আটকে আছে এভারেস্টের ক্যাম্প ওয়ান এবং টুতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৪ সদস্যের একটি দল তাদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে।
ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ২০টি অ্যাটম বোমার সমান
শনিবার আঘাত হানা রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির ২০টি থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার সমান ছিল বলে বর্ণনা করেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.