ছাত্রলীগ নেতার হাতে শিক্ষিকা লাঞ্ছিত জগন্নাথে তোলপাড়

পহেলা বৈশাখে ছাত্রী লাঞ্ছিত হওয়ার পর এবার ছাত্রলীগের এক নেতার হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। লাঞ্ছিত শিক্ষিকা লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক লুবনা জিবিন। তিনি ফেসবুকে ওই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। ঘটনার পর মামলা করেছেন ওই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে থেকে ঘটনার তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে শিক্ষক সমিতি। ক্লাস বর্জন করে মানবপ্রাচীর করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রোববার দুপুরে ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মো. আরজ মিয়া এই শিক্ষিকাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও স্যোশাল মিডিয়ার তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন শিক্ষিকা জানান, ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস শেষে ক্যাম্পাস ত্যাগ করছিলেন লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক লুবনা জিবিন। নতুন ভবনের সামনে আসার পর ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র মো. আরজ মিয়া (রেজি: নং ১০০১০৪০৬৬৩ রোল নং ১০০৬৮৭, সেশন ২০০৯-১০) ওই শিক্ষিকার গতিরোধ করেন। তিনি যে দিকে যান ওই ছাত্র ওই দিকে গিয়ে তার গতিরোধ করেন। তিন চারবার এই রকম করার পর আমরা বুঝতে পারি সে ইচ্ছাকৃতভাবে ওই শিক্ষিকাকে এ রকম করছে। এরপর ওই শিক্ষিকা তাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার সমস্যা কী? ওই ছাত্র শিক্ষিকাকে বলে, তুমি ক্যাম্পাসে নতুন এসেছো। কোন বিভাগে পড়ো। ওই কথা বলে ওই শিক্ষিকার কাঁধে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। পরে শিক্ষিকা তাকে শার্টের কলার ধরে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই পুরো ক্যাম্পাসে বিষয়টি জানাজানি হলে প্রক্টর অফিস ওই ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তাকে নিয়ে থানায় যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ও তার দলবল। ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কোন বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী ওই শিক্ষিকা। পুরো ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। এটি ইউটিউব ও স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই এই ঘটনার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করে এর বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করেছেন।
এদিকে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ছাত্রলীগ নেতার বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরের সামনে দুপুরে শিক্ষকরা এ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল হোসেন বলেন, শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী ছাত্র নামের কলঙ্ক হলে?ও একজন ক্রিমিনাল। আমরা এ অপরাধীর ছাত্রত্ব বাতিলসহ স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি করছি। একই দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে শতাধিক শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।  এ সময় তারা ছাত্রলীগ নেতার স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেন।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি ড. মীজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ওই ঘটনার পরপরই আমরা একটি ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এর পেছনে যারাই জড়িত তাক উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। ছাত্রলীগ ওই ছাত্রকে ছিনিয়ে নেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক ও শিক্ষিকা ওই ঘটনার প্রত্যক্ষর্শী। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, পুরো ঘটনার সময় আমি ছিলাম। এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ছিল অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে। ওই ছাত্র আমার কলিগকে (লুবনা জিবিন) বারবার গতিরোধ করে। কলিগ এটার কারণ জানতে চাইলে সে তার উপর ক্ষিপ্ত হয় তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে ওই ছাত্র তার ওড়না ধরে টানা দেয়। এরপর আমার কলিগ তাকে ধাপ্পড় দিয়ে বলে তুমি আমাকে চিনো। আমি এখানের শিক্ষক। এরপর ওই ছাত্র তার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেনি। একপর্যায়ে আমাদের আরও কয়েকজন কলিগ এগিয়ে আসলে তাকে ধরে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে আধা ঘণ্টা আটকিয়ে রাখার পর পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়। তাকে মেইন গেটের সামনে নিয়ে যেতেই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কয়েকটি ছেলে পুলিশের গাড়ির থেকে তাকে নামিয়ে নিয়ে যায়। পুলিশ তখন ছিল একেবারে নির্বিকার। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এক শিক্ষিকা তার ছাত্রের কাছে নিরাপদ নয়, তখন সাধারণ ছাত্রীদের নিরাপত্তা আজ কোথায়? পহেলা বৈশাখে যে ঘটনা সেটি বিচার না হওয়ার জন্য আজকে তারা আমাদের (শিক্ষিকদের) ওপর হাত তুলতে সাহস দেখিয়েছে।
প্রক্টর অফিস জানায়, ঘটনার পর ওই শিক্ষিকা ও আরও কয়েকজন তাকে প্রক্টর অফিসে তুলে দেয়। কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পার না হতেই তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে তাকে যখন ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন পুলিশ ছিল নীরব। এই ঘটনায় পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে তোলপাড় তৈরি হয়। ঘটনার কোন প্রতিকার না পেয়ে গতকাল ওই শিক্ষিকা কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন।
এ বিষয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত শিক্ষিকা লুবনা জিবিন মানবজমিনকে বলেন, রোববার দুপুরে আমি নতুন ভবন থেকে আমার বিভাগে (সামাজিক বিজ্ঞান ভবন) যাওয়ার পথে ওই ছাত্রের সঙ্গে পথে দেখা হয়। তাকে পথ ছেড়ে দিতে আমি বামে যাই সেও বামে যায়। এমন তিনবার হওয়ার পরে আমি ধারণা করি ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত। তাই বিরক্ত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কি সমস্যা?’ তোমার। তখন সে আমাকে বলে নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইছো? কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো? এবং সে আমার কাঁধে ধাক্কা দেয় এবং কপালের পাশে চড় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমিও তাকে চড় দেই এবং কলার ধরে প্রক্টর অফিসের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। যাতে আমি তাকে ছেড়ে দেই সেজন্য সে আমার ওড়না ও জামা ধরে টান দেয়। তারপরও আমি তাকে জোর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাই। প্রক্টর অফিসে সে জানায়, তিনি যে শিক্ষক তা আমি বুঝতে পারেনি এবং বুঝতে পারলে এমন আচরণ করতাম না। তিনি বলেন, তার বক্তব্যের মানে দাঁড়াচ্ছে, আমি শিক্ষক না হয়ে ছাত্রী হলে তার আচরণ সঠিক ছিল অথবা এই ক্যাম্পাসে আমার ছাত্রীরা প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে।
তিনি তার ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস  লিখেছেন, কোন রূপে নারী নিরাপদ? সারা দেশ যখন পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে সংঘটিত যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে উত্তাল, ঠিক সে সময়েই আজ ২৬শে এপ্রিল ২০১৫ তারিখে দুপুর আনুমানিক ১২টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন ছাত্র কর্তৃক আমি জঘন্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হই, যা যৌন নিপীড়নের সমতুল্য। প্রতিনিয়ত আমরা দেখি নারীরা এ সমাজে স্ত্রী হিসেবে নিগৃহীত, কন্যা হিসেবে বঞ্চিত, দরিদ্র হিসেবে নিপীড়িত। আজ নতুনভাবে দেখলাম শিক্ষক হিসেবেও লাঞ্ছিত। আমি নারী শিক্ষক বলেই হয়তো সে আমাকে শারীরিক আক্রমণ করে ঘটনাস্থল থেকে পালাতে চেয়েছিল। হয়তো সে ভেবেছিল, আমার জামা-ওড়না ধরে টান দিলেই আমি নারীসুলভ আতঙ্কে তাকে ছেড়ে দেবো। কিন্তু আমি ছেড়ে দেইনি। কারণ তখন আমার চোখে ভেসে উঠেছিল আমার অসংখ্য ছাত্রীর মুখ এবং আমি ভেবেছি আজ এই ছাত্র নামক নিপীড়ককে ছেড়ে দেয়ার মানে হলো আমার প্রতিটি ছাত্রীকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেয়া।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন। নারী সংহতি এক বিবৃতিতে এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তি দাবি করা হয়। বিবৃবিতে বলা হয়, নিপীড়ক যতো শক্তিশালী ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকুক না কেন নিপীড়ন মুক্ত ক্যাম্পাস এবং সমাজ গড়তে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব দোষী ব্যক্তির যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় নারীসংহতি পাড়ায়-মহল্লায়-প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলবে।
এর আগে গত বছর ১৩ ই মার্চ বেদখল হওয়া হল উদ্ধার ও নতুন হল নির্মাণসহ শিক্ষকদের ৬ দফা দাবিতে শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে হামলা করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ও তার দলবল। এতে সিরাজুল ইসলামসহ তিন ছাত্রলীগ নেতা রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলমকে লাঞ্ছিত করে। পরে ক্যাম্পাস থেকে সিরাজুল ইসলামকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে সে ছাত্রলীগ থেকেও বহিষ্কার। ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন সময় শিক্ষক সমিতি আন্দোলন করে।

No comments

Powered by Blogger.