ছাত্রলীগ সম্পদ না আপদ? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

কোনো সভা-সমাবেশে সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী হাজির হলে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হন। কেননা, এতে তাঁদের আয়োজন এবং এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি যেন উল্টো। সাংবাদিকদের ব্যাপারে তাদের মারমুখী মনোভাব ও আচরণের প্রকাশ ঘটছে বারবার। এতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বিব্রত হচ্ছেন, সাংবাদিকদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছেন, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন, কিন্তু এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারছেন না কিছুতেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—ছাত্রলীগের এই উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের লাগাম কার হাতে?
১১ মার্চ ২০-দলীয় জোটের সহিংসতার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের উদ্যোগে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার হন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের আট সাংবাদিক। সামান্য বচসাকে কেন্দ্র করে এই সাংবাদিকদের কিল-ঘুষি-লাথি মারা থেকে শুরু করে মূল্যবান প্রচার সরঞ্জাম ভেঙে ফেলা পর্যন্ত সব অপকর্মই তারা করেছে মঞ্চে উপবিষ্ট নেতাদের চোখের সামনে। নেতারা কেউ কেউ মঞ্চ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি করেও তাদের বিরত রাখতে পারেননি।
ওবায়দুল কাদের এ ঘটনায় ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন সাংবাদিকদের কাছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরউদ্দিন এই উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সাংবাদিকেরা সেদিনের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও আলোকচিত্র সরবরাহ করার পরও এই কদিনে আইনগত বা সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিউজে) বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সর্বশেষ ১৬ মার্চ পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে সেখানে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপাতি মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করে অবিলম্বে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, পুলিশ আন্তরিক, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় পুলিশ কমিশনারের কথিত ‘আন্তরিকতা’ নিয়ে সংশয় জাগে।
সম্প্রতি নগরের চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও মুহসীন কলেজে ১৪ ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে পুলিশ একে ২২ রাইফেল, থ্রি নট থ্রি বন্দুক, রকেট ফ্লেয়ারসহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। সেখান থেকে ‘শিবির কর্মী’ সন্দেহে গ্রেপ্তার হয় ৭২ জন ছাত্র। এ রকম বড় অভিযান চালানোর মতো সক্ষমতা রয়েছে যে বাহিনীর, তারা স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ পাওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে ‘আন্তরিকতা’ প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।
মহিউদ্দিন চৌধুরী দলের উচ্ছৃঙ্খল এই কর্মীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানালেও তাঁর ওমরাহ্ পালন শেষে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সংবর্ধনার নামে ছাত্রলীগের কর্মীরা বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা ও কয়েক কিলোমিটার সড়কপথে যে অরাজক পরিস্থিতি ও জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করেছিল, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি।
ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি কী বা কেমন, এটা জানার জন্য খুব দূরে যাওয়ার দরকার নেই। সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ক্লিক করলেই ভেসে ওঠে রামদা বা কিরিচ হাতে ছুটে যাওয়া কিছু যুবকের ছবি, কাউকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করছে—এমন কিছু তরুণের হিংস্র অবয়ব। শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করে তুলছে, লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীকে, উত্ত্যক্ত করছে কোনো মেয়েকে—এ ধরনের অসংখ্য ছবির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বা ইতিবাচক আন্দোলন-সংগ্রামের ছবি।
শুধু চট্টগ্রামেই ককটেল ফাটিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, রাস্তায় নেমে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ গত দুই সপ্তাহের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে সারা দেশে ছাত্রলীগের বর্তমান অবস্থার একটি সামগ্রিক চিত্র যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সিটি কলেজে নিজেদের দলের কর্মীকেই হাতের আঙুল ও রগ কেটে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে তারা। লোহাগাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে শোভাযাত্রায় সংঘর্ষে জড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে নয়জন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাঁচজনকে পাঠানো হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
দলের যখন এই অবস্থা, তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও মুহসীন কলেজে শিবিরের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা প্রসঙ্গে অদ্ভুত এক মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, শিবিরের এই অস্ত্র মজুতের পেছনে বামপন্থী শিক্ষকদের সহযোগিতা আছে। মনে পড়ে, চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শেখর দস্তিদারকে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ‘শিবির দস্তিদার’ নামে অভিহিত করেছিলেন সাবেক সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসি। এককালের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শেখর দস্তিদার মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সৈনিক ছিলেন। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিই শিবিরনিয়ন্ত্রিত এই কলেজে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এক সাংসদ তাঁকে ‘শিবির’ বলে চিহ্নিত করতে দ্বিধা করেননি।
বদিউজ্জামানকে স্মরণ করতে বলি, এই কলেজে শিবিরের হাতে যেমন প্রাণ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা তোবারক, তেমনি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহাদাতকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছিল শিবির কর্মীরাই। তাঁর না জানার কথা নয়, চট্টগ্রাম কলেজে অস্ত্র উদ্ধার ও শিবির কর্মীদের আটক করার পর শিবিরের মহানগর আইটি সম্পাদক নাজমুস সাকিবকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে তদবির করেছেন কক্সবাজার অঞ্চলের আওয়ামী লীগদলীয় একজন সাংসদ। শিবির কর্মীদের ছাড়িয়ে নিতে মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাক্ষরযুক্ত সনদ নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরাই। সরষের ভেতর ভূত থাকলে সেই ভূত না তাড়িয়ে অন্যকে দোষারোপ করা শূন্যে তরবারি ঘোরানোরই নামান্তর।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.