ছাব্বিশে মার্চ রাজনৈতিক সদাচারে প্রেরণা জোগাক by আহমদ রফিক

ছাব্বিশে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত। মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বাঙালিবিরোধী অভিযান এবং ঢাকায় সেই রাতে সূচিত গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার আহ্বান নিয়ে ছাব্বিশে মার্চ দিনটির আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে উঠে আসা। এর পর থেকে দিনটির উদ্যাপন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। তবে নানা ঘটনার সুবাদে গোটা মার্চ মাসটি স্বাধীনতার মাস হিসেবে রাজনীতি-সংস্কৃতিসেবী বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
মার্চের সেই উদ্যাপন এ বছর আনেকটাই ব্যাহত হয়েছে রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার কারণে। বিগত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে বিএনপি জোট ঘোষিত ‘শান্তিপূর্ণ অবরোধ ও হরতালের’ নামে যে সহিংসতা, নাশকতা ও প্রতিদিন পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা স্বাধীনতার মাসটিকেও ছাড় দেয়নি। ছাড় দেয়নি পরীক্ষার্থীদেরও।
এই ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতালের বৈশিষ্ট্য এক কথায় সহিংসতা ও নাশকতা, অবাঞ্ছিত মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ মানুষের যন্ত্রণা। স্বভাবতই হরতালের কয়েক দিন পরই দেখা গেল মানুষ হরতালের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তারা প্রাত্যহিক প্রয়োজনের টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। রাস্তায় রকমারি যানবাহন চলছে। ঢাকার রাজপথে বহুল দৃষ্ট যানজট। এক কথায় মানুষ হরতাল প্রত্যাখ্যান করছে। সরকার কঠোরভাবে নাশকতা মোকাবিলার চেষ্টা চালাচ্ছে পুরোপুরি সফল না হওয়া সত্ত্বেও। মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে দুই মাসের লাগাতার হরতাল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থই বলা চলে।
তবু স্বীকার করতে হয়, সারা দেশে এক ভয়াবহ অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানুষ যথারীতি কাজ করছে ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে। দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলছে নাশকতার ভয়ে অনেক সতর্কতা নিয়ে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে চলছে রেলগাড়িও। নাশকতা ও মৃত্যুর ঘটনা কমে এলেও তা বন্ধ হয়নি। কিন্তু সরকার সমঝোতার পথে হাঁটতে নারাজ। অন্যদিকে বিএনপি জোটের কর্মসূচিও অব্যাহত রয়েছে।
এমন এক অস্বাভাবিক অবস্থায় বিএনপি নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণায় মানুষ আশা করেছিল যে হরতাল-অবরোধের যন্ত্রণা থেকে হয়তো মুক্তি পাওয়া যাবে, নতুন কোনো নমনীয় কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। কিন্তু না, মানুষকে হতাশ করে নেত্রীর ঘোষণা: হরতাল-অবরোধ চলছে, চলবে। এমনকি সংবাদ সম্মেলনে যথারীতি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেননি তিনি। তাঁর বক্তব্যে নমনীয়তার সুর থাকলেও সরকারি দলের নীতি ও অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটতে দেখা যাচ্ছে না।
ফলে জাতীয় জীবনে অনিশ্চিত অস্থিরতা সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ঘিরে। স্বভাবতই তা স্পর্শ করছে কমবেশি সব শ্রেণির মানুষকে। করছে শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী থেকে শীর্ষ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের। শেষোক্ত শ্রেণি তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছে সরকার ও বিএনপি জোটের প্রতি অবস্থা স্বাভাবিক করার আবেদন জানিয়ে। কিন্তু সংকট থেকে মুক্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এমন এক পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে দলীয় বুদ্ধিজীবীদের উদাসীনতা আমাদের অবাক করে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে দেশের শিক্ষিত শ্রেণি দ্বিদলীয় আনুগত্যের অন্ধতায় বাধা পড়ে গেছে। এমনকি এলিট শ্রেণিও, দেশ ও জাতির স্বার্থে যাদের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানে থাকার কথা। তাদের মেধা, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় রাজনীতির সঠিক দিকনির্দেশ করার কথা। যে ক্ষুদ্রসংখ্যক মানুষ নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তাঁদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে না। দেশ একটি তামসিক জড়ত্বের মধ্যে সময় পার করছে। এর বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়ানোর আগ্রহ বোধ করছে না। এ অবস্থা সমাজের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
দুই
অবস্থা বিচারে মনে হচ্ছে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি চলতেই থাকবে, যদিও হরতাল তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ হরতাল ডাকা দলের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠবে, একসময় হয়তো তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। আওয়ামী লীগ কি সেই দিনটির অপেক্ষা করছে, যখন ব্যর্থ হরতালে বিএনপির জনসমর্থনের ভিতটি নড়বড়ে হয়ে যাবে?
হয়তো এমন বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক কেউ কেউ মনে করেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিএনপির উচিত অর্থহীন হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে জনস্বার্থমূলক কর্মসূচির বাস্তব অবস্থান গ্রহণ করা, যা জনসমর্থন আকর্ষণ করতে পারে। এই মুহূর্তে যে কারণে হোক মানুষ কারও ক্ষমতা দখল বা কারও ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে না। মানুষ নিজ স্বার্থের বিষয়টি ভালো রকমই বোঝে। সেদিক থেকে বিচার করলে এই মুহূর্তে বিএনপি ভুল রাজনীতির বাসে চেপে বসেছে। এ পথে তার জনভিত্তি মজবুত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অন্যদিকে বর্তমানে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য যে বার্তা নিয়ে আসছে, তা–ও খুব মঙ্গলদায়ক নয়। সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের বড় আপদ সমাজবিরোধী দুর্বৃত্তশক্তি ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী অপশক্তির বিস্ফোরক তৎপরতার অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ বৃদ্ধি। ওরা ঘোলা পানিতে শিকার করতে দক্ষ। আর স্থানীয় ধর্মীয় জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক সমর্থনের বিষয়টি কারও অজানা নয়।
এই অবাঞ্ছিত চাপ যদি যথেষ্ট শক্তিমান হয়ে ওঠে, তবে তা ক্ষমতাহীন দলের জন্য অশুভ ঘণ্টাই বাজাবে। এবং তা শুধু বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যই নয়, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্যও বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক অপরাধ খুন-খারাবির প্রবলতা সমাজে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, তার যোগফল অপশক্তির পক্ষেই যাওয়ার কথা, সরকার ও তার আইনশৃঙ্খলার পক্ষে নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থা গুম, খুন, নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অপরাধপ্রবণতা সামাজিক নৈরাজ্যের দিকেই হাঁটতে শুরু করেছে। কে বলতে পারে মৌলবাদী জঙ্গি শক্তি এ সুযোগ নেবে না? সম্প্রতি গোয়েন্দা সূত্রের এক খবরে প্রকাশ যে কট্টর শক্তিমান জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নাকি জাতীয় স্থাপনায় আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে। অনুকূল পরিবেশে তেমন কিছু ঘটানোর সামর্থ্য তাদের রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমানে শক্তিমান জঙ্গিগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাত কম নয়।
পরিস্থিতির সার্বিক বিবেচনায় ক্ষমতাসীন দলের আত্মতৃপ্তির বড় একটা সুযোগ নেই। বড় কোনো ধ্বংসাত্মক ঘটনার আগে জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে কঠোর সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। তবে সেই ব্যবস্থা যেন গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে লঙ্ঘন না করে।
অস্বীকারের উপায় নেই যে বর্তমান সংকট ব্যক্তি ও দলবিশেষের ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিলেও এর চরিত্র রাজনৈতিক। তাই সমস্যা বা সংকট সমাধানের পথটাও রাজনৈতিক। এ সত্য বিবদমান উভয় পক্ষকে স্বীকার করে নিয়েই এগোতে হবে। এবং সামাজিক অস্থিরতার নিরসন ঘটাতে ক্ষমতাসীন সরকার দায়বদ্ধ। তবে সেই দায় অস্থিরতার স্রষ্টা দলও অস্বীকার করতে পারে না।
এ অবস্থায় উভয় পক্ষকেই সমাজ ও জনস্বার্থের বিবেচনা মাথায় রেখে সমঝোতা বা মীমাংসার উপায় খুঁজতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এটা তাদের দায়বদ্ধতা। পদক্ষেপ একই সঙ্গে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হারজিতের কোনো প্রশ্ন নেই। যে অবরোধ-হরতাল ও তজ্জনিত সাধারণ মৃত্যুর সূচনা ঘটিয়েছে বিএনপি জোট, তার রাজনৈতিক দায় স্বীকার করে দায়মুক্তির রাজনৈতিক পথ ধরে এগোনোর কোনো বিকল্প তার হাতে নেই। এর বড় কারণ, তার কর্মসূচির ব্যর্থতা।
আমাদের বিবেচনায় বিএনপিকে তাই জনবিরোধী হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে জাতীয় স্বার্থ ও জনস্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সমঝোতার পদক্ষেপ নিতে হবে, জেদ এ ক্ষেত্রে ক্ষতিকরই হবে। পাশাপাশি সরকারপক্ষের উচিত বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়ে সংকটের বরফ গলতে সাহায্য করা। প্রয়োজনে সম্ভাব্য নাশকতা রোধে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এভাবে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা ও নাশকতার অবসান ঘটবে না। জাতীয় অর্থনীতি ক্রমেই বিপর্যস্ত হতে থাকবে, যা কোনো পক্ষের কাম্য হওয়ার কথা নয়।
আমাদের রাজনীতির একটি বড় সমস্যা সদাচারের অভাব। যেমন বক্তব্যে, তেমনি আচরণে। গণতান্ত্রিক সদাচারে এক পা এগিয়ে যাওয়া তাদের কাছে হার বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে বিদেশি উদাহরণ তাদের বোধোদয় ঘটায় না। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনমনীয় জেদ ও অনড় অবস্থানের পক্ষে যুক্তি নেই। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
এসব কথা মাথায় রেখে জাতীয় জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছাব্বিশে মার্চকে রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় অর্থবহ করে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এটা উপলক্ষ। আমাদের প্রত্যাশা, ছাব্বিশে মার্চ বিবদমান দলগুলোকে সদাচারের স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করে সংকটের অবসান ঘটাক। সমঝোতা শুরু হোক সিটি নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।
আহমদ রফিক: প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.