‘ফিরে পাবো কখনও ভাবিনি’ -হেলাল-আনোয়ারের বাড়িতে আনন্দের বন্যা

বাংলাদেশীদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে দেশটিতে। কোন পক্ষই তাদের শত্রু মনে করে না। এ কারণে উদ্বেগ থাকলেও বিশ্বাস ছিল হয়তো তাদের ফেরত দেবে অপহরণকারীরা। লিবিয়ার একটি তেলক্ষেত্র থেকে অপহরণের শিকার হেলাল উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন উদ্ধার হওয়ার পর দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শহিদুল হক বুধবার এভাবেই তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। বলেন, তাদের উদ্ধার করতে গত ১৮ দিনের প্রায় প্রতিদিনই কার্যক্রম চালানো হয়েছে। একাধিক সোর্স কাজে লাগিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এসব সোর্সই তাদের মুক্ত করতে সহযোগিতা করেছে। তাদের মুক্ত হওয়ার সংবাদটাও সোর্সের মাধ্যমেই পাওয়া গেছে। এদিকে গত ১৮ দিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে অপহৃতদের পরিবারের। ফিরে পাবেন- এ আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বজনরা। আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে মঙ্গলবার মধ্যরাতে তাদের উদ্ধার হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর স্বস্তি ফিরে এসেছে পরিবারে। ত্রিপোলিস্থ বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে হেলাল উদ্দিনের পরিবারে ফোন করে উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এর আগে ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে লিবিয়ার বন্দিদশা থেকে ফোন করে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন হেলাল উদ্দিন। আর আনোয়ার হোসেনের লিবিয়া প্রবাসী শ্যালক মাহমুদের মাধ্যমে গতকাল সকালে তার মুক্তির খবর পান স্বজনরা।
গত ৬ই মার্চ জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের দক্ষিণ গজারিয়া গ্রামের হেলাল উদ্দিন ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার আনোয়ার হোসেনকে ত্রিপোলি থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে আল ঘানি নামে একটি তেলক্ষেত্র থেকে অপহরণ করে একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ। তাদের সঙ্গে আটক হন আরও ৪ জন ফিলিপিনো, ১ জন অস্ট্রিয়া ও একজন ঘানার নাগরিক।
রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শহিদুল হক গতকাল দুপুরে ফোনে বলেন, অপহৃতরা উদ্ধার হওয়ার পর ত্রিপোলি থেকে ৭০০ কিলোমিটার পূর্বে সিরত হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, তাদের ওপর নির্যাতন চালানো না হলেও খাবার দিয়েছে কম। এ কারণে তারা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। অপহৃতরা যে অস্ট্রিয়ান কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন সেই কোম্পানি তাদের পাসপোর্ট নিয়ে ত্রিপোলিতে ফেরত আনতে গাড়ি পাঠিয়েছে। তারা সেখানে পৌঁছালে তাদের সঙ্গে কথা হবে বলেও জানান তিনি।
উদ্ধারের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, তাদের উদ্ধারে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত ছিলো। লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ফিলিপাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিয়মিত ফোন ও মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছে। সাহায্য চাওয়া হয় রেডক্রিসেন্টের। এছাড়া, একাধিক সোর্সের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়েছে। অপহরণ হওয়ার পরপরই চারটি দেশের (বাংলাদেশ, অস্ট্রিয়া, ফিলিপাইন ও চেক প্রজাতন্ত্র) সমন্বয়ে একটি ক্রাইসিস কমিটি গঠন করা হয়। ক্রাইসিস কমিটি ও সোর্সগুলোর মধ্যে নিয়মিত তথ্য আদান প্রদান হয়েছে। গত ১৩ তারিখে এই গ্রুপের সভা হয়েছিল তিউনিশিয়ায়। এই গ্রুপটিই সার্বক্ষণিকভাবে সোর্সগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। সোর্সই গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে এই ক্রাইসিস কমিটিকে তাদের উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে। তিনি বলেন, তিনটি সোর্স থেকে আমরা তাদের উদ্ধার হওয়ার খবর পাচ্ছি। তাদের মোবাইল দিয়েই কথা বলেছেন তারা। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমাদের বিশ্বাস ছিলো, অপহরণকারীরা বাংলাদেশীদের ছেড়ে দেবে। কারণ এদেশে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। সব পক্ষই তাদের ভাল মনে করেন। তাছাড়া, মুসলিমদের তারা সাধারণত ধরে না। তিনি জানান, ঘটনার পর ওই কোম্পানিতে কাজ করা অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আটক করার পর অপহরণকারীরা মুসলিমদেরকে হাত তুলতে বলেছিলো। এ সময় এক সুদানি হাত তুললে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমাদের দুইজন সে সময় হাত না তোলায় তাদের নিয়ে যায়। তবে কারা তাদের আটক করেছিল সে ব্যাপারে এখনও কিছু জানা যায়নি বলেও শহিদুল হক জানান।
এদিকে লিবিয়ার অস্ত্রধারীদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। হেলাল উদ্দিনের বোন জহুরা বেগম জানান, ভাইকে আর কখন পাবো ভাবিনি। সবাই বলে জঙ্গিদের হাতে ধরা পড়লে কেউ বাঁচে না। উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে সবার মুখে হাসি ফুটেছে। তিনি বলেন- এখন আমাদের দাবি, সরকার যেন আমার ভাইকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
অপরদিকে ১৮ দিন পর জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় মুক্তির খবরে আনন্দ ও স্বস্তি ফিরে এসেছে আনোয়ার হোসেনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর গয়েছপুরেও। বুধবার সকালে তার শ্যালক লিবিয়া প্রবাসী মাহমুদ মোবাইল ফোনে এ খবর জানালে পরিবারের লোকজন শুকরিয়া আদায় করেন। খবর পৌঁছার পর থেকেই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ও আশেপাশের এলাকাবাসী ভিড় জমাচ্ছেন। এর আগে, মঙ্গলবার রাত ১২টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আনোয়ার হোসেনের মুক্তির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের ফার্স্ট সেক্রেটারি মোজাম্মেল হোসেন ই-মেইলে তার শ্যালক মাহমুদকে নিশ্চিত করেন। গত ৪ঠা মার্চ থেকে তার স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কথা হয়। এরপর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এখন নিরাপদে দ্রুত ফিরবেন এমনটাই আশা করছেন স্বজনরা। উল্লেখ্য, দেশটিতে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বর্তমানে সেখানে কর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেছে সরকার।

No comments

Powered by Blogger.