একাত্তর, যেভাবে শুরু by হাসান ফেরদৌস

সালমান রুশদি তাঁর শেইম উপন্যাসে পাকিস্তানকে বর্ণনা করেছেন ‘আ কান্ট্রি নট সাফিশিয়েন্টলি ইমাজিন্ড’। তাঁর কথায়, দেশটি বানানো হয়েছিল জোড়াতালি দিয়ে। যে ভূমিখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান, তার নেতারা জন্মেছিলেন সে দেশের বাইরে। স্বাধীনতার পর দেশটি বরাবর লড়াই করেছে ইতিহাসের দুই ধারার সঙ্গে—একদিকে ওপর থেকে আরোপিত ইতিহাস, অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইতিহাস। দেশটির বিভিন্ন অংশের সম্পর্কও বরাবর ছিল বিরোধপূর্ণ। রুশদি লিখেছেন, এ এমন এক দেশ, যার নির্মাণের পেছনের
স্বপ্ন ছিল অসম্পূর্ণ। হয়তো দেশটা এমন, যা নিয়ে যথেষ্ট কল্পনাই ছিল না।
রুশদি ঠিকই ধরেছেন। স্বাধীনতার জন্য চাই মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অবলম্বন করে দেশের মানুষ বৈরী শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে নামে। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে চলে সে লড়াই। পাকিস্তানের জন্মকে ‘অসম্পূর্ণ স্বপ্নের প্রকাশ’ বলা হলেও একই কথা বলা যাবে না তার পূর্বাংশকে নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, সেখানে পাকিস্তানের কোনো ঠাঁই ছিল না। মাত্র ২৪ বছর লেগেছিল ভিন্ন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে।
বস্তুত, একটি ভিন্ন, স্বতন্ত্র দেশের কথা পাকিস্তানের পূর্বাংশের মানুষ নিজেদের মনে এঁকে নেয় দেশভাগের আগেই। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির দুই মাস আগে গণ-আজাদী লীগ এক ইশতেহার প্রকাশ করে স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে এভাবে:
‘রাজনৈতিক স্বাধীনতার মূল্যই নাই, যদি স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে।...আমরা স্থির করিয়াছি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব।’
অন্য কথায়, পাকিস্তান গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান হয়তো একটি নতুন পতাকা পাবে, কিন্তু দেশের মানুষের পরাধীনতা দূর হবে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সম্প্রসারণ, এই মার্কসীয় তত্ত্বটি গণ-আজাদী লীগের নেতা-কর্মীদের জানা থাক বা না থাক, তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন, যে মধ্যস্বত্বভোগী অর্থনৈতিক কাঠামো পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে বাঙালির মুক্তি আসবে না। দেশভাগের এক বছর না পেরোতেই ভাষার প্রশ্নে যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে, বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্ণয়ের সেই লড়াইয়েও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটি প্রচ্ছন্ন ছিল। বাংলার বদলে উর্দু চাপানোর চেষ্টা হবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার গলা টিপে মেরে ফেলা—এ কথা প্রথম সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। দেশভাগ হতে না হতেই তিনি লিখলেন, ‘...বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে।...ইহা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বহির্গতও বটে।’
সে কথা আরও খোলামেলাভাবে প্রকাশ করেন ড. এনামুল হক। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে এক নিবন্ধে তিনি যুক্তি দেখালেন, বাঙালির ওপর উর্দু চাপিয়ে দিলে শুধু যে তার সাংস্কৃতিক মৃত্যু হবে তা-ই নয়, তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যুও ঘটবে। ‘এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা, বাণিজ্য ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় ও পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।’
অন্য কথায়, পাকিস্তান নামের দেশটি শুধু নামে নতুন হবে, কিন্তু বাস্তব অর্থে বাঙালির ওপর ঔপনিবেশিক শাসনের কোনো পরিবর্তনই হবে না। পরিবর্তন আসবে শুধু ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমে, যেদিন বাঙালি নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা হবে। পূর্বাংশের নেতারা স্বাধীনতার এই চেতনাটি খুব সুপরিকল্পিতভাবে প্রোথিত করতে সক্ষম হন দেশভাগের একদম গোড়া থেকে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেরও আগে থেকে। তবে ভাষা আন্দোলন যে তাকে একটি মজবুত গাঁথুনির ওপর বসায়, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের কাছে স্বাধীনতার প্রশ্ন কিছুটা বিমূর্ত মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু ভাষার মতো নিত্যদিনের একটি বিষয় যখন সামনে এসে দাঁড়াল, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর কোনো বাধা থাকল না।
ভাষা আন্দোলনের একটি জনপ্রিয় চরিত্র ছিল। ভাষার দাবিটির সারার্থ দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ ছিল, কারণ এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের রুটি-রুজির প্রশ্ন। তাদের সন্তান–সন্ততির কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। সে জন্য এই আন্দোলন শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। ঠিক সে কারণে এই আন্দোলনের অগ্রবাহিনী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন ছাত্ররা।
পরবর্তী ইতিহাস আমাদের জানা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয় ছিল বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। যে কথাটা এত দিন মনের মধ্যে গোপনে বেজে চলেছিল, যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় বিজয়ের ফলে এবার তা সরব হওয়ার সুযোগ পেল। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ঘোষণা করেন, তিনি (পূর্ব পাকিস্তানের) স্বাধীনতার পক্ষপাতী। ২২ মে করাচিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ফজলুল হক জানান, মন্ত্রিসভা গঠনের পর যে প্রশ্নটি সর্বাগ্রে আলোচিত হবে, তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। কত দ্রুত স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হবে, সে বিষয়ে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। ‘তবে আমার মন্ত্রিসভার জন্য অন্যতম প্রধান কাজই হবে স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা।’
হতে পারে স্বাধীনতা ও স্বাধিকার—এ দুটি বিষয় গুলিয়ে ফেলেছিলেন হক সাহেব, যে কারণে ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মাথায় পাকিস্তান সরকার তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে মুসলিম লিগকে ভোট না দিয়ে বিচ্ছিন্নতাপন্থী একটি জোটের পক্ষে ভোট দেন, তা থেকেই স্পষ্ট, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পক্ষেই তাঁরা রায় দিয়েছিলেন।
সে ঘটনার মাত্র ১৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় আরেক ঐতিহাসিক নির্বাচন। তাতে দেশের মানুষ এমন একজন নেতার পক্ষে তাঁদের রায় ঘোষণা করেন, কয়েক মাস আগেও যাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল দেশভাগের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। তার পরের ঘটনা তো আমাদের সবারই জানা।
না, অপরিকল্পিত আকস্মিকতার ফলে স্বাধীনতা আসেনি বাংলাদেশের। পাকিস্তান হয়তো পর্যাপ্ত স্বপ্ন ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সৃষ্টি ছিল মুক্তিপাগল এক জাতিগোষ্ঠীর স্বপ্ন ও সাধনার ফসল।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক।

No comments

Powered by Blogger.