সর্বত্র রক্তক্ষরণ by কাফি কামাল ও সিরাজুস সালেকিন

৬০ দিন ধরে চলছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আহূত অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। প্রতি সপ্তাহে দুই দফায় ৫ দিন করে পালিত হচ্ছে হরতাল। ৫ই জানুয়ারি শুরু হওয়া এ আন্দোলনে প্রতিদিনই ঘটছে সহিংস ঘটনা। বিরোধী জোটের আন্দোলন কর্মসূচি ও সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তৈরি হয়েছে এক দমবদ্ধ পরিস্থিতি। জাতীয় জীবনের সর্বত্রই রক্তক্ষরণ। বিপর্যস্ত জনজীবন। প্রতিনিয়তই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। রাজপথে পুড়ে কয়লা হচ্ছে মানুষ। দুর্বৃত্তদের পেট্রলবোমার আঘাতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন অন্তত ১৪০০ জন। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় মারা গেছে বিরোধী জোটের ৬০ নেতা-কর্মী-সমর্থক। এ সময় সরকার সমর্থকদের হামলায় নিহত হন আরও অন্তত ১৫ জন। এ সময় গুম হয়েছেন ২১ জন। এ সময় সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন কর্মী-সমর্থকও দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন। পুলিশের গুলি ও সরকার সমর্থকদের হামলায় আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় শতাধিক নেতাসহ অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মী। নৈরাজ্য ও নাশকতার ঘটনায় দায়েরকৃত অন্তত ১৪০০ মামলায় আসামি করা হয়েছে আড়াই লাখের বেশি বিরোধী জোট সমর্থকসহ সাধারণ মানুষকে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘর ছাড়া বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীসহ কয়েক লাখ সাধারণ মানুষ। আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অচল হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতিসহ উৎপাদনশীল খাত। দফায় দফায় পরীক্ষা পেছানো ও ক্লাস বন্ধ থাকায় হুমকির মুখে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। প্রতিদিন রাজপথের পাশাপাশি রেলপথ-নৌপথেও ঘটছে নাশকতা। দুই মাসে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল অবস্থায় আছে। মহাসড়কে চলন্ত গাড়িতে একের পর এক পেট্রলবোমা হামলার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দূরপাল্লার যাত্রীদের মাঝে। অবরোধে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ২২০০ যানবাহন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্যানুসারে, দেশে এক দিনের হরতাল বা অবরোধে গড়ে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে ৬০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এদিকে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি থেকে নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ এবং পরবর্তীতে কৌশলগত কারণে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। তাকে কার্যালয় থেকে বের করতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও খাবার সরবরাহ বন্ধ করেছে সরকার। নাশকতার ঘটনায় হুকুমের আসামি হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা হয়েছে একাধিক হত্যা মামলা। দুর্নীতির মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও কার্যালয় তল্লাশির ব্যাপারে আদালতের অনুমতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের প্রধান দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি। বাংলাদেশের চলমান নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ও বিরোধী জোট দুই পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। সংলাপের ব্যাপারে বিরোধী জোট ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও কঠোর অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি সরকার।
পেট্রলবোমায় নিহত ৬৪ ও আহত ১৪০০: ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালকে কেন্দ্র করে ৪ঠা জানুয়ারির পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা জায়গায় যাহবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আগুনে পুড়ে প্রাণহানি ঘটেছে ৬৪ জনের। যাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। নিহতদের মধ্যে সাধারণ যাত্রী ২৯ জন ও বাকি ২১ জন পরিবহন শ্রমিক। নিহত যাত্রীদের মধ্যে পুলিশ সদস্য, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, বয়স্ক নারী এবং শিশুও রয়েছেন। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রলবোমা হামলায় আহত হয়েছে ১৪০০ জন। যাদের মধ্যে আগুনে পুড়েছে ৩৫০ জন। রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ২০০ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৫০ জন। তাদের মধ্যে চারজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
১৪০০ মামলা, আসামি আড়াই লাখ, গ্রেপ্তার ২৫০০০ হাজার: অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াসহ বিরোধী জোটের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই দায়ের হচ্ছে একের পর এক মামলা। খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে দায়ের হয়েছে একাধিক নতুন মামলা। ইতিমধ্যে সারা দেশে দায়ের হয়েছে অন্তত ১৪০০ মামলা। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে আড়াই লাখের বেশি নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ সাধারণ মানুষকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী জোটের অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, দৈনিক মানবজমিনের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের দাবিকৃত সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে রাজধানীর নাশকতাপ্রবণ এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের প্রায় ৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং বিএনপিপন্থি আইনীজীবীরা দাবি করেছেন, গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। তারা জানান, দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতিদিনই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তার অনেক তথ্যই গণমাধ্যমে পৌঁছে না। অনেক তথ্য প্রকাশিত হয় না। এদিকে একই সময়ে রাজধানী ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, যশোর, মাগুরা, খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, বরিশালসহ দেশের বেশ কয়েকটি বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক মামলা দায়ের ও এসব জেলায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়েছে দফায় দফায়। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, যশোর, গাইবান্ধা, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েক জেলা প্রতিদিনই উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থক গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দলের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব ও বিভিন্ন জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অঙ্গসংগঠনের অন্তত দুই শতাধিক সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 
অতীতের আন্দোলনে হতাহতের চিত্র: ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি-জুন মাসে ৬ষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছিল ৮২ জন। এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ৩৬ ও সাধারণ মানুষ ৩২ জন এবং অজ্ঞাত ১৪ জন।  ৮২ জনের মধ্যে পুলিশের গুলিতে ২২ জন, সংঘর্ষ-হামলায় ২৬ জন, বোমা হামলায় ১৯ জন ও অন্যান্য ১৫ জন।  ২০০১ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছে ৯৬ জন। এর মধ্যে দলীয় কর্মী ৭৯ জন ও সাধারণ মানুষ ১৭ জন। হামলায় ৫৫ জন, বোমায় ১৮ জন, গুলিতে ১৪ জন ও অন্যান্য ৯ জন। ২০০৬ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছে ৩২ জন। এর মধ্যে দলীয় কর্মী ২৮ জন, সাধারণ মানুষ ৪ জন। হামলায় নিহত হয়েছে ২৭ জন, গুলিতে ৩ জন ও অন্যান্য ২ জন। সর্বশেষ ১০ম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন দলীয় কর্মী ও ৪০ জন সাধারণ মানুষ। হামলায় নিহত হয় ২৫ জন, পেট্রলবোমায় ২২ ও অন্যান্য ১২ জন।
বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা: গত দু’মাসে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল অবস্থায় আছে। মহাসড়কে চলন্ত গাড়িতে একের পর এক পেট্রলবোমা হামলার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দূরপাল্লার যাত্রীদের মাঝে। অবরোধে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ২২০০ যানবাহন। পোড়ানো হয়েছে সহস্রাধিক গাড়ি। অবরোধ-হরতালে মহাসড়কে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়নি দু’মাসেও। ব্যাহত হচ্ছে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-বগুড়া, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কমপক্ষে ৮০০ স্থানে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। সর্বাধিক নাশকতা হয়েছে নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, রংপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, বগুড়া, গাইবান্ধা, চট্টগ্রামে। যানবাহনে বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে রংপুর, গাইবান্ধা ও কুমিল্লায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে, একদিন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে ৩৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ যাবৎ এ খাতে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সরকার ১৪৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিককে ৪ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। তবে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-রাজশাহী, নীলফামারী-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা রুটের অন্তত ১০০টি স্থানে ট্রেন, রেলপথ ও রেল স্টেশনে দফায় দফায় নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে এর পরিমাণ ছিল সর্বাধিক। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পর্যটনের এ মওসুমে অবরোধের কারণে রেলে আয় কমেছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। একই সময়ে অবরোধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি টাকা। সংস্থাটির ৬০ শতাংশ গাড়ি বন্ধ রাখা হচ্ছে। নৌপথে নাশকতা চালানো হয়েছে ৬ দফা। এদিকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, অবরোধে রাজধানীতে প্রায় ৩০০ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নাশকতার ঘটনায় ৩৩০টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৬০০ জনকে। পুলিশের তথ্যানুসারে, তেজগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নাশকতা ঘটানো হচ্ছে বেশি। তবে ককটেল বিস্ফোরণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা। অবরোধ শুরুর পর থেকে এ এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণেই আহত হয়েছে অন্তত ৫৫ জন।
আর্থিক ক্ষতি দেড় লাখ কোটি টাকা: অবরোধ-হরতালে দু’মাসে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্যানুসারে, দেশে এক দিনের হরতাল বা অবরোধে গড়ে ২৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে ৬০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। সরকার বলে আসছিল আগামী এক সপ্তাহের মাঝেই অবস্থা স্থিতিশীল হবে। কিন্তু দুই মাস পার হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। তবে অবস্থার পরিবর্তন না হলেও ইতিমধ্যেই দেশের অর্থনীতির দশা বেহাল হয়েছে। সার্বিক অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা জানান, হরতাল-অবরোধে দেশের সব খাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানিতে সমস্যায় পড়েছে। বিদেশী অর্থছাড় কমেছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। অর্থনীতিতে সবদিকে এতটা অচলাবস্থা আর কখনও দেখা যায়নি বলে তারা মনে করেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মানবজমিনকে জানান, এভাবে চলতে থাকলে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। খোঁজ নিলে জানা যাবে, নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এখন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছে। মানুষের হাতে কোন কাজ নেই। কর্মহারা এসব মানুষ পথে পথে ঘুরছে। অস্বস্তিকর পরিবেশ দীর্ঘায়িত হলে প্রবৃদ্ধির টার্গেট, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা কোন ভাবেই বাস্তবায়ন হবে না বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ। অন্যদিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) হিসাবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে প্রতিদিন অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হচ্ছে তা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপির হিসাব অনুযায়ী ০.১৭ শতাংশ। সে হিসাবে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২,২৭৭ কোটি ৮৬ হাজার টাকা, তবে প্রতিদিন শিল্প উৎপাদন সক্ষমতায় ২৫ শতাংশ ক্ষতি ধরলে এর পরিমাণ প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকারও বেশি। এ হিসাবে গত ৬০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। সংগঠনগুলোর হিসাবে দেখা গছে, গত দুই মাসের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্তে ক্ষতি ৪১,৭০০ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে ১৮,০০০ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ১৭,২৮০ কোটি, আবাসন খাতে ১৫,০০০ কোটি, পর্যটন ১২,৬০০ কোটি, পাইকারি বাজার ৯,০০০ কোটি, উৎপাদন খাত ৬০০০ কোটি, রাজস্ব আদায় ১,৯৮০ কোটি, সিরামিক খাতে ১,২০০ কোটি, পোল্ট্রি শিল্প খাতে ১,০৮০ কোটি, প্লাস্টিক খাতে ১,০২০ কোটি, বীমা খাতে ৯০০ কোটি, হকার্স খাতে ৯০০ কোটি, স্থলবন্দরে ক্ষতি ৬০০ কোটি ও হিমায়িত খাদ্য খাতে ৪৮০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সংগঠনের তথ্যানুসারে, অবরোধ-হরতালের প্রথম ৪৫ দিনে পোশাক খাতে ৪০ হাজার কোটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি, খুচরা ও পাইকারি বিক্রিতে ২০ হাজার কোটি, আবাসন খাতে ১০ হাজার ৫০০ কোটি, কৃষি ও পোল্ট্রি খাতে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি, পর্যটন খাতে ৯ হাজার কোটি ও উৎপাদনশীল শিল্প খাতে ৫ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে অসুস্থ রোগীদের যাতায়াতও ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত: অবরোধ-হরতালে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের ৫ কোটি শিক্ষার্থী। বছরের শুরুতেই অবরোধ হরতালের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষাসূচি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চার কোটি ৪৪ লাখ শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা পুরোপুরি ক্লাস শুরু করতে পারেনি। হরতালের কারণে প্রতি শুক্রবার ও শনিবার স্কুল খোলা রাখা হলেও অবরোধের কারণে এ দু’দিনও ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না। নিরাপত্তার কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কম। অন্যদিকে ২রা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ৬ই ফেব্রুয়ারি। এতে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী ভোগান্তির শিকার হয়। একটি পরীক্ষাও নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী হয়নি। হরতালের কারণে পরীক্ষা হয় শুধু শুক্র ও শনিবার। এ ছাড়া আগামী ১লা এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও সংশয়ে আছে ১৩ লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া ফেনীসহ কয়েকটি জায়গায় শিক্ষার্থীরাও হামলার শিকার হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.