নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় কিসের? by আখতারুজ্জামান সজল

স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এ জাতির এত বড় দুঃসময়, এত ব্যাপক দুর্যোগ আগে কখনো আসেনি। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক গভীর খাদের কিনারায়Ñ যেকোনো সময় তলিয়ে যেতে পারি। সব শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মানুষ একটু আলোর মুখ দেখতে চাই, কবে কখন আলোর মুখ দেখব, আদৌ আলো খুঁজে পাব কি না। দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ এবং নৈরাজ্যবাদের স্পর্ধা লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন- খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, গ্রেফতার ও রিমান্ড। এসব কিছুর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তার তেমন উদ্যোগ সরকারের নেই। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার কিছু মাপকাঠি রয়েছে। রাষ্ট্রকে উদার হতে হবে। উদাসীন কিংবা হিংস্র হলে রাষ্ট্র গণতন্ত্র হারাবে। আমাদের রাষ্ট্র গণতন্ত্র থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি বলা যায়Ñ রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে হিংস্র হয়ে উঠেছে। জানমালের নিরাপত্তা নেই, বাকস্বাধীনতা খর্ব হয়েছে এবং জনগণ রাষ্ট্রকে ভয় পায়। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। দীর্ঘদিনের সভ্যতা এবং সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের দেশ গৌরবান্বিত। অথচ আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র কতটা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে প্রথম সারির বিভিন্ন দেশ। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের এত সমালোচনা ইতিহাসে কখনো হয়নি। ক্ষমতাসীনদের ভাষ্য অনুযায়ী শাসকদের শিবিরে যারা আছেন, একমাত্র তারাই গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি-অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। বাকি সবাই গণতন্ত্রের শত্রু, যুদ্ধাপরাধী, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যকারী। ধারণাটি অবাস্তব ও বানোয়াট। সব জায়গায় ভালো-মন্দ বিরাজমান। আর সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যকারী কেউ জন্ম থেকে হয় না। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, ধর্মীয় শিক্ষা না থাকা, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা, সমাজের উপেক্ষা, সরকারি দমননীতি, পরিবেশ প্রভৃতি কারণে মানুষ সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
শাসক দল নিজেদেরকে বারবার গণতান্ত্রিক বলে দাবি করছে। অথচ গণতন্ত্রের যে প্রধান মাধ্যম নির্বাচন, সেটাই বর্তমানে কলুষিত। এ জন্য ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করলে ভুল হবে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতে বেশির ভাগ সরকারই নির্বাচনব্যবস্থার ওপর এখনকার মতো নগ্ন হস্তক্ষেপ করেনি; কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু বর্তমানে নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যদি নির্বাচনে নির্বাচক স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে অপারগ কিংবা ফলাফল নির্ধারিত হয় ভিন্ন উপায়ে, সেখানে নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। এরূপ নির্বাচনের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত হয় যে সরকার, জনগণের বৃহদাংশের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। কিভাবে নির্বাচনকে অর্থহীন করে তোলা হয়েছে, তার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা উচিত : যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করি অথবা করার অধিকার রাখি, তারা এ অধিকার থেকে গত বছর ৫ জানুয়ারি বঞ্চিত হয়েছি। এই নির্বাচন ছিল প্রহসন। দেশের বৃহত্তম দল বিএনপির (২০ দলীয় জোট) অনুপস্থিতিতেই নির্বাচন হয়ে গেল যেখানে ভোটার ছিল না, জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না। সরকার গঠন হলো এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৪৪ জন সংসদ সদস্য হলেন। সরকার সবকিছু নিজের মতো করে ভাবছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য যত আইন দরকার, তা প্রণয়ন করছে। উপজেলা নির্বাচনেও পেশি ও অর্থ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা যদি নিরপেক্ষ হয়, তাহলে ফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু হতে বাধ্য। দূষিত নির্বাচনব্যবস্থা দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়।
শুধু ভোটদানের ব্যবস্থাকেই অথবা নির্বাচনের যে পদ্ধতি, তাকেই যদি গণতন্ত্রের শেষ কথা বলি, তবে ভুল হবে। শুধু নির্বাচনব্যবস্থা নিরপেক্ষ হলেই লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না এবং আদর্শ শাসনব্যবস্থা লাভ করা সম্ভব হয় না। এ জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনোনয়নে দলগুলোকে অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
বিভিন্ন মহলে এইরূপ অভিযোগ প্রায়ই ওঠে, বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত, এমনকি বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে মনোনয়ন দান করে। অনেক ক্ষেত্রে এরা বিজয়ীও হয়। অর্থবল এবং পেশিবলই কার্যকর হয় সে ক্ষেত্রে। গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা আদালতের দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রার্থী করা উচিত হবে না।
গণতন্ত্রের নামে প্রকৃতপক্ষে দলতন্ত্র কায়েম হচ্ছে এ দেশে। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে হয়, বিশেষ দলের গুটিকয়েকের ইচ্ছাকে জনগণের ইচ্ছা বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। যা জনবিরোধী, তাকেও বলা হচ্ছে জনকল্যাণ নীতি। গণতন্ত্রের নামে সংবিধানের দোহাই দিয়ে যেসব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে আসলে তা কতটা জনকল্যাণকর তা সবার কাছেই স্পষ্ট। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, বিভিন্ন দফতরে যাদেরকে বড় পদে বসানো হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই দক্ষ ও উপযুক্ত নন। তাদের বিশেষ যোগ্যতা হলো, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। অদক্ষ মানুষ দেশ অথবা জনগণের কল্যাণে যত না কাজ করে, তদপেক্ষা দলের অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে বেশি। তাদের কারণে সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জাগ্রত বিবেক হলো সংবাদপত্র। কেননা সংবাদপত্র Watch dog এর কাজ করে। কিন্তু যদি তাকে বেঁধে রাখা হয় অথবা তার মুখে এমন কিছু পুরে দেয়া হয় যাতে সে কিছু বলতে না পারে, তখন এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়। ক্ষমতায় পৃষ্ঠপোষক কিছু সংবাদপত্রকে দাক্ষিণ্যদান করা হয়, অন্য দিকে সমালোচনাকারী সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে করা হয় সব চেষ্টা। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে নির্ভীক সংবাদপত্রের কণ্ঠকে রোধ করা হয়েছে। শত প্রলোভনের মধ্যে দু-একটি পত্রিকাই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে। গঠনমূলক সমালোচনাকে ক্ষমতায় আসীন যারা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা মেনে নিতে পারেন না। King can do no wrong- এই আদর্শে বিশ্বাসী থাকে শাসকপক্ষ। গণতন্ত্র বলিষ্ঠ করতে সংবাদপত্রগুলোকে শত প্রলোভন ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিরপেক্ষতা রক্ষা করে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা দেশের ও জাতির কাছেই দায়বদ্ধ। আর কারো কাছে নয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কলুষিত করার জন্য বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাও কম নয়। দেখা যাবে, এমন অনেক বিষয়ে এসব ব্যক্তি সরকারের সমর্থনে মিছিল, মিটিং করছেন, যেগুলো তাদের বিষয় নয়। এর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে তাদের অগ্রণী ভূমিকা নেয়া উচিত, সেখানে তারা চরম নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করে থাকেন। আসলে সরকারের দাক্ষিণ্য ও সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এই অবাঞ্ছিত আচরণে লিপ্ত। সংবাদপত্রের মতো বুদ্ধিজীবীরাও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন এটাই কাম্য। প্রচারযন্ত্রগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দল হরতাল কিংবা অবরোধ আহ্বান করল, অনেক ক্ষেত্রেই সফল হলো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্র ঘোষণা করবে, হরতাল বা অবরোধ সফল হয়নিÑ ব্যর্থ হয়ে গেছে। অপর দিকে দেখা যায়, সরকারি দলের সভা-সমাবেশে বাধা নেই, কিন্তু বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ নিয়ে অনেক বাধ্যবাধকতা। একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল না থাকলে রাষ্ট্র ও সরকারের কাজের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরার কেউ থাকবে না। তখনি রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমার বাইরে চলে গিয়ে নির্যাতনের শঙ্কা সৃষ্টি করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার মাপকাঠি রয়েছে। রাষ্ট্র যদি কঠোর হতে থাকে, জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। অব্যাহত এই অবরোধ, হরতাল দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, অনেকটা গণ-আন্দোলনের মতো। এতগুলো নিরীহ, নিরপরাধ ও অসহায় মানুষের মৃত্যু হলো, দেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হলো, এ রকম চলতে থাকলে আরো ক্ষতি হবেÑ আরো প্রাণ যাবে জেনেও সরকার সঙ্কট সুরাহার উদ্যোগের গরজ বোধ করে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সার্থক করে তুলতে সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে। বিরোধী দলকে গঠনমূলক আন্দোলনে বাধা দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশে তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। তা থেকে উত্তরণের পথ, সব দলকে নিয়ে একটি ইতিবাচক সংলাপ। গণতন্ত্রকে আরো বেশি সার্থক করে তুলতে ক্ষমতাসীন দলকে সঙ্কীর্ণ চিন্তার বাইরে এসে দেশ ও জাতির স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা হবে সবার মঙ্গলের জন্য। এ দিকে, সারা দেশ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী। কাজের কিংবা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মানুষ ঢাকামুখী হতে পারছে না। জনমনে ধারণা, সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে। স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই সরকারের কাছে প্রত্যাশা করে। সরকারের পক্ষে যদি জনসমর্থন থাকে, তাহলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে ভয় কিসের? বিলম্ব না করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবেÑ যেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের হারানো ভোটাধিকার যেন আবার প্রয়োগ করতে পারে।
এখনই সঙ্ঘাত থামানো উচিত, অন্যথায় পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু মিছিল ও মিটিংয়ে নির্বিচারে গুলি চালানোকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বললে ভুল হবে না। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে এটা কাম্য নয়। সামরিক শাসন অথবা স্বৈরতন্ত্র কখনোই গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না।
sazal2025@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.